নির্বাচনী ইশতেহারে বরেন্দ্র অঞ্চলের খরামুক্ত ও পানি ব্যবস্থাপনা সুশাসনের দাবি

প্রেস বিজ্ঞপ্তি (রাজশাহী)

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে বরেন্দ্র অঞ্চলের খরামুক্ত ও পানি ব্যবস্থাপনার সুশাসনসহ উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন বিষয়ক কর্মপরিকল্পনা রাখার দাবি করেছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের তরুণ-যুবকসহ নাগরিক সমাজ।

আজ সোমবার (২৭ নভেম্বর) সকাল ১১ ঘটিকায় রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন ও আলোচনা সভার মাধ্যমে খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের সমন্বিত উন্নয়নে ৭ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক ও বরেন্দ্র অঞ্চলের বৃহৎ যুব ঐক্যি বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের (ঠধৎবহফৎধ ণড়ঁঃয ঋড়ৎঁস) এর আয়োজনে উক্ত সংবাদ সম্মেলনও আলোচনা সভার ম্যাধমে বক্তারা বলেন, ‘বাংলাদেশের সন্নিহিত জনপদগুলোর মধ্যে আদিভূমি হিসেবে পরিচিত এবং উচুঁ নীচু মাঠ আর লাল মাটির বৈশিষ্ট্য খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চল। ২২টি জেলা নিয়ে এই খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চল। যার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁ মোট ৬টি জেলা খরার উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে নেতিবাচক প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের আবহাওয়া, জলবায়ু আরো মারাত্মক সংকট তৈরি করছে।’

গংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০২২ সালে উত্তরাঞ্চলে অন্যান্য বছরের তুলনায় বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৬৬% বৃষ্টিপাত কম ছিলো। পানিসংকটের কারণে এই অঞ্চলে জীববৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিকসহ মানুষের পেশা এবং কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য মারাত্মক ঝঁকির মধ্যে পড়েছে। দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। সামাজিক সহিংসতাগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানির জন্য কৃষক আত্মহত্যা করছে। খরা ও পানি সংকটের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিজমি কমে যাওয়াসহ, বাস্তুতন্ত্রের ব্যাঘাত ও মানুষের আর্থ-সামাজিকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সার্বিকভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলে খরার নেতিবাচক প্রভাব বহুমাত্রিক আকারে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু খরার ব্যাপ্তি ও বিপর্যয় বিবেচনায় নিয়ে উপরের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের বিশ্লেষণ করলেও এখনো অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় খরা বিষয়ে অগ্রগতির মনোযোগ দৃশ্যমান নয়। পরিকল্পনা ও বাস্তবাস্তবায়নেও সমন্বিত কোন অগ্রগতি নেই।

সংবাদ সম্মেলনে বারসিক’র গবেষক ও আঞ্চলিক সমন্বয়কারি মো. শহিদুল ইসলাম বিগত সময়ের বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহার বিশ্লেষণ করে জানান, বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিলো। তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারে বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা এবং পানি ব্যবস্থপনার সুশাসন বিষয়ক দিকগুলো ছিলো না। বড় দলগুলোর কোনটিতে হাওর, উপকূলীয় এবং পার্বত্য এলাকার পরিবেশ, জলবায়ু উন্নয়ন বিষয়ে ইশতেহারে উল্লেখ থাকলেও সেখানে বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা এবং পানি ব্যবস্থাপনার সুশাসন, খরামুক্ত করার দিকগুলো কোনভাবেই উল্লেখ নেই। তিনি আরো জানান, আমরা যদি বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের বিগত সময়ের নির্বাচনী ইশতেহারে দেখি, সেখানেও খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের বিষয়ে কোন কথা উল্লেখ নেই। বিশেষ করে বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০১৮ সাল) আগে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ যে ইশতেহার জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলো তাতে দেখা যায় ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষা’ দফার লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় উপকূল-সুন্দরবন, হাওর ও ভাটি অঞ্চলের মিঠা পানির প্রাপ্যতা, সবুজ বেষ্টনীসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার কথা বলা হলেও সেখানে কোথাও বিশেষ ও বৃহৎ খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলবায়ু ও পানি ব্যবস্থাপনার দিকগুলো আমরা দেখতে পাইনি। যার ফলে অবহেলিত থেকে গেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি সমস্যা সমাধানের কার্যকর দিকগুলো। অন্যদিকে বাংলাদেশের বৃহৎ কয়েকটি দল যেমন বিএনপি সেই সময়ে (২০১৮) তাদের ১৯ দফা, জাতীয় পার্টির ১৮ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ও প্রতিশ্রুতি দেয়, এগুলোর মধ্যে কোথাও দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা, পরিবেশ ও জলবায়ুর দিকগুলো তেমনভাবে উল্লেখ করেনি।

অন্যদিকে ছোট দলগুলোর মধ্যে বাম ধারার দলগুলোতে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার দিকগুলো তুল ধরতে দেখা যায়। তবে কোথাও খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলকে নিদিষ্ট করেনি। সার্বিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে জনগণকে যে প্রতিশ্রুতি বা ইশতেহার দেয়, তার কোনটিতেই বাংলাদেশর উত্তর-পশ্চিমের বিশেষ অঞ্চল খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সুরক্ষা, খরা ও পানি ব্যবস্থাপনার সুশাসনগুলো উল্লেখ নেই। অথচ বাংলাদেশের মধ্যে সব থেকে বেশি পানি শূন্যতা এবং পানি সংকট এবং পানি কেন্দ্রিক সামাজিক সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এই বরেন্দ্র অঞ্চলে। সেই সাথে এই এলাকার প্রাকৃতিক জলাভূমি, জলের উৎসগুলো বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। কৃষি, শস্য ফসলের বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। মানুষসহ সকল প্রাণের খাদ্য সার্বভৈৗমত্ব হুমকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে বরেন্দ্র অঞ্চলের উন্নয়নে ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম এর সভাপতি শাইখ তাসনীম জামাল। দাবিগুলোর মধ্যে আছেঃ

০১. সকল রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খরা দুর্যোগ,পানি সংকট সমাধানসহ জলবায়ু ন্যায্যতায় পরিকল্পনা যুক্ত করতে হবে।
০২. খরা মোকাবলোয় বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করতে জনমতামতকে গুরুত্ব দিয়ে এর সমন্বিত উন্নয়নকে যুক্ত করতে হবে।
০৩. বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা দুর্যোগপীড়িত জনগোষ্টীর জন্য ‘খরা ভাতা’ চালুর পরিকল্পনা যুক্ত করতে হবে।
০৪. খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য আলাদা ‘বরেন্দ্র জলবায়ু তহবিল’ গঠনের পরিকল্পনাসহ দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে হবে।
০৫. বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা ও পানি সংকট সমাধানে পদ্মা নদী ব্যাপক খনন এবং এর সাথে যুক্ত সকল নদ নদীগুলোসহ জলাধারগুলো খনন করে সুপেয় পানিসহ কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার পরিকল্পনা যুক্ত করতে হবে।
০৬. সকল রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
০৭. বরেন্দ্র অঞ্চলের সকল উন্নয়ন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সবুজ প্রবৃদ্ধি কৌশল (এৎববহ এৎড়ঃিয ঝঃৎধঃবমু) গ্রহণ বিষয়কে যুক্ত করতে হবে।

আলোচনার শেষে বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম এর সাধারণ সম্পাদক ও আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সহ-সভাপতি সাবিত্রী হেমব্রম বলেন- আমরা মনে করি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলের জলবায়ু উন্নয়নে খরামুক্ত করন, পানি ব্যবস্থাপনার সুশাসনসহ জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষার পরিকল্পনাগুলো যুক্ত হবে। সেই সাথে সমতল আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভূমি কমিশন গঠনের দিকগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে রাখার দাবি জানান তিনি।

happy wheels 2

Comments