জলাবদ্ধতার সময় নারী ও শিশুরা সবচে’ বেশি বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে
সাতক্ষীরা থেকে শেখ তানজির আহমেদ
‘জলাবদ্ধতার সময় নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। সেসময় জন্ম নেওয়া শিশু হয় প্রতিবন্ধী, অথবা পুষ্টির অভাবে হাড় জিরজিরে হয়ে যায়। মা ও শিশুসহ সব বয়সের মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। জলাবদ্ধতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।’
সাতক্ষীরার প্রাণ বেতনা নদী ও নদী তীরবর্তী নারী-শিশুর প্রাণ প্রবাহের দাবিতে সম্প্রতি আয়োজিত গণমাধ্যম সংলাপে ভুক্তভোগী মানুষ এভাবেই প্রকাশ করেন তাদের সুখ-দুঃখের কথা।
সংলাপে বেতনা পাড়ের মানুষ জানান, নদী ভরাট হয়ে বেতনা পাড়ের পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় প্রতিবছর ছয় মাস ধরে এলাকায় জলাবদ্ধতা বিরাজ করে। এই কারণে বেতনা তীরে কোন ফসল নেই। গাছ-গাছালি মরে গেছে। হাঁস-মুরগি গবাদি পশু পালনেরও সুযোগ হারিয়ে গেছে। যে বেতনা তীরে কর্মসংস্থানের প্রাণচাঞ্চল্য ছিল, সেই বেতনার দু’ধারের মানুষ কাজ না পেয়ে এদিক-ওদিক চলে গেছে। তারা বললেন, “এখন নদীতে নৌকা চলে না। কাজের খোঁজে মানুষ পেশা বদল করেছেন। জলাবদ্ধতাকালীন শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। সবাই ঘর-বারান্দায় বন্দী হয়ে থাকে, চারদিকে বিষাক্ত পানি। এ পানিতে চলাফেরা করলে চর্মরোগ ছড়িয়ে পড়ে।”
এলাকাবাসী বলেন, “যে যখন ক্ষমতায় আসে, তারা শুধু প্রতিশ্রুতিই দেয়। কিন্তু কাজ আর করে না। বছর তিনেক আগে বুজে যাওয়া বেতনা খনন শুরু করেছিল সরকার। আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম, কিন্তু খননের নামে যা দেখলাম, কিছুদিনের মধ্যেই আবারও পলিতে ছাপিয়ে গেছে বেতনা। বর্ষা মৌসুমের আগে এই খনন কাজ চালালেও বর্ষার শুরুতেই দুই পাশের মাটি ধসে পড়ে বেতনার সেই বিকৃত চেহারায় ফিরে গেছে।” এ নিয়ে গ্রামবাসী আন্দোলনের স্বপ্ন দেখেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তারা আরও বলেন, “বেতনার দুই তীর প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। চরজুড়ে তারা বাড়ি-ঘর ইটভাটা তৈরি করে পানি প্রবাহ বন্ধে সহায়তা করেছে।” বেতনা পাড়ের বৃদ্ধ মোকছেদ আলী বলেন, “ছাগলার গেটসহ কয়েকটি স্লুইচ গেট দিয়ে এখন আর পানি নিষ্কাশন হয় না।” নদীর তলদেশ গেট অপেক্ষা উচু হয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন চারপাশে ছোট ছোট পকেট ঘের করে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।”
পয়ঃনিষ্কাশন একটি বড় সমস্যা উল্লেখ করে ভুক্তভোগীরা বলেন, “আমাদের এলাকায় কোন স্থায়ী পাকা পায়খানা নেই। বিশেষ করে নারীদের সমস্যা খুব বেশি। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও ইউনিয়ন পরিষদ কিছু কিছু কাজ করলেও তা আমাদের চাহিদা মেটাতে পারেনি। পানির কবল থেকে বেঁচে থাকার জন্য নিজ নিজ উদ্যোগে ভিটে মাটি উচু করতে হয়েছে। কিন্তু দরিদ্র পরিবারগুলো তা পেরে উঠছে না।”
বেতনা পাড়ের শিশুরা পারিবারিক দারিদ্র্য, যোগাযোগ সংকট এবং অন্যান্য কারণে স্কুল ছেড়ে কাজের সন্ধানে এদিক-ওদিক চলে গেছে। এখন এলাকায় কর্মসংস্থানের খুবই অভাব। ক্ষেত নেই, ফসলও নেই। পেঁয়ারা, পেঁপে, সজিনা, কাঠালসহ নানা ধরনের ফল-ফলাদির গাছ অকালে মারা গেছে। লবণাক্ততার দাপটে সেখানকার পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
বেতনায় যখন প্রাণ ছিল, তখন জোয়ার-ভাটায় ছোটবড় নৌকা চলাচল করেছে। এগ্রাম থেকে ওগ্রামের যাতায়াতের সেই মাধ্যম এখন আর নেই। জলাবদ্ধতার সময় বাড়ি-ঘর ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিতে হয়। প্রতিবছরের এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চান জানিয়ে তারা বলেন, “প্রয়োজনে আমরা সামাজিক আন্দোলন করবো। নারী-পুরষ সবাইকে নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ঘেরাও করবো।” বেতনা তীরে জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিটি পরিবারে পুষ্টিহীনতা দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন, “চিকিৎসা করেও কোন ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।”
বেতনা খনন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জোরালো দাবি তুলে গ্রামবাসী বলেন, “বেতনা খননের মাটি ফেলতে হবে নদীর মূল সীমানার বাইরে। তাহলে বৃষ্টিতে ধুয়ে আবার নদীতে পড়বে না। এছাড়া বেতনার সাথে সংযুক্ত সকল খাল উন্মুক্ত করে স্লুইচ গেটগুলো সচল করতে হবে।” তারা বলেন, “জলাবদ্ধতায় এলাকায় সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দেয়। টিউবওয়েলগুলোয় লোনা পানি উঠছে।” এ ব্যাপারে তারা সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
উল্লেখ্য যে, বারসিক এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা টিম আন্তর্জাতিক পানি দিবস উপলক্ষে এই গণমাধ্যম সংলাপের আয়োজন করে। সংলাপে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে ও বাংলানিউজের জেলা প্রতিনিধি শেখ তানজির আহমেদের সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম কামরুজ্জামান, সিনিয়র সাংবাদিক সুভাষ চৌধুরী, কল্যাণ ব্যানার্জি, মিজানুর রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল, মো. আসাদুজ্জামান, হাফিজুর রহমান মাসুম, বেতনা পাড়ের বাসিন্দা রহিমা খাতুন, হাসিনা খাতুন, অঞ্জলি বিশ্বাস, নাজমা বেগম, আয়শা খাতুন, রাবেয়া, জেসমিন এবং ওই এলাকার শতাধিক মানুষ।