সুন্দরবনের মাছ গনগনে
সাতক্ষীরা থেকে শাহীন ইসলাম
পৃথিবী বিখ্যাত আমাদের সুন্দরবন হাজারও মাছের প্রাকৃতিক ভান্ডার। গনগনে, দাঁতিনা, কাইন, পায়রা, ভেটকী, বাগদা চিংড়ি, পারশে, ভাঙগান, তেড়ে/তাড়ি, জাবা, লুচু, আমাদি, ভোলা, খয়রা, কইভোল, বাশপাতা, চেটা বেলে, বগি, কাঁকড়া গাং কৈ, কাঁটাসহ নাম না জানা অসংখ্য প্রজাতির মাছের আধার এই সুন্দরবন। রাতভর বনের খাল-খাড়ীতে বাঘ-সাপ-কুমির-ডাকাতে ভয়কে তোয়াক্কা না করে জীবন জীবিকার তাগিদে মাছ ধরে হাজার হাজার জেলে। খুব সকালে সুন্দরবন নদীর পাশে গেলে দেখা যায় জেলে নারী-পুরুষের মাছ বাছাই কর্মব্যস্ততা। সুন্দরবন মাছের বাস্তুসংস্থান চেনা-জানা প্রবীণ জেলে সুপদ মন্ডল (৮৭) বলেন,“এতসব মাছের মধ্যে বনের গনগনে মাছ সবচেয়ে মূল্যবান। এ মাছের যে গনাগুন তা টাকার সাথে তুলনা করা যায় না। অনেকে কাছে মাছটি “দুধ-মাছ” নামেও পরিচিত। দেখতে অনেকটা আধাকালো ও ভেদা। মাথার দিকে মাংস বেশি। লেজটি চিকন ও কম মাংস যুক্ত। তুলতুলে নরম। পিঠের উপর মেঘের আচড়। এটি লবণ পানির মাছ। বিশেষ প্রয়োজনে এই মাছ খুবই উপকারী। অনেক সময় মেয়েদের সন্তান জন্মের পর সন্তান মায়ের বুকের দুধ পায় না। তখন এই গনগনে মাছ “ঝুল”করে খেলে মায়ের বুকের দুধ বাড়ে এবং মা তার সন্তানকে প্রয়োজনীয় দুধ পান করাতে পারেন। অনেকে উপকার পেয়েছে। এই মাছ সৃষ্টিকর্তার দান। আমাদের এই বাদাবনের খাল-নদীতে পাওয়া যায়। কুৎসিত দেখতে বিধায় অনেকে ফেলে দেয়”। তিনি আরো বলেন,“এ“ মাছ না, দেবতা”।
সুপদ মন্ডল জানান, সুন্দরবনে যত মাছ আছে তার মধ্যে গনগনে মাছ তাঁর মায়ের মত। তিনি বলেন, “এক এক সময় এক এক গোনে এক এক রকম মাছ পাওয়া যায়। বনের গাছ, ফল ও মাছের সাথে একটা সম্পর্ক আছে। যখন কেওড়া ফল পাকে, তখন সাগর থেকে ছোট-বড় অনেক মাছ বাদার খালে চলে আসে। পাকা ফল গাছ থেকে পানিতে পড়ে। আর মাছেরা তা খায়। আমরা তখন অনেক মাছ পাই।” তিনি আরও বলেন, “বনে মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। চিন্তা হয় গনগনে মাছ না পাওয়া গেলে অনেক সন্তান মায়ের বুকের দুধ পাবে না। বাদার মাছের অনেক গান বান্দা যায়। অনেক গান নিজে গাই। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত বনে মাছ ধরবো”।
বনের প্রতিটি সম্পদের সাথে বননির্ভর মানুষের আত্মার, প্রাণের এবং আত্মনির্ভরশীলতার সম্পর্ক। যেমন গনগনে মাছের সাথে মা ও সন্তানের এক অদৃশ্য বন্ধন। সুন্দরবনের প্রতিটি সম্পদ পৃথিবীর সেরা ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য। কারণ পৃথিবীর আর সকল বন থেকে এটি আলাদা। প্রবীণ জেলে সুপদ মন্ডলের কাছে গনগনে মাছও পৃথিবীর সেরা ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য। “ভোদড়” দিয়ে মাছ ধরায় অভিজ্ঞ এই প্রবীণ জেলে স্বপ্ন দেখেন “যত দিন বাদাবন বেঁচে থাকবে, ততদিন “দুধমাছ”ও বেঁেচে থাকবে। প্রবীণ জেলে সুপদ মন্ডলের“ ভালোবাসার দুধ-মাছের বাস্তুসংস্থান সুন্দরবন আজীবন বেঁচে থাক এটাই আমাদের প্রত্যাশা ।