জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মাটিও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে
সিলভানুস লামিন
মাটি হচ্ছে বর্জ্য ও ধুলোর মিশ্রণের সমন্বয়ে গঠিত উপাদান। অন্য কথায় বলা যায়, মাটি হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম জীবন্ত বাস্তুসংস্থান। মাটিতে কোটি কোটি উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, পোকামাকড়, ছত্রাক এবং অন্যান্য জীবন্ত প্রাণী রয়েছে। এসব অদৃশ্য প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া, উদ্ভিদ মাটির জৈব উপাদান সৃষ্টিতে, গঠনে এবং বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে মাটিতে জৈব পদার্থের আকারে প্রচুর পরিমাণ কার্বন রয়েছে। অন্য কথায় বলা যায়, ভূ-মণ্ডলের উদ্ভিদ জগতে যত পরিমাণ কার্বন রয়েছে তার দ্বিগুণ রয়েছে মাটিতে। তবে গত শতকে আধুনিক কৃষির আর্বিভাবের পর থেকে মাটির উর্বরতাকে কোনপ্রকারে আমলে না নিয়ে দেদারসে রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে মাটির জৈব পদার্থ দিনে দিনে হ্রাস পেতে শুরু করে। বাণিজ্যিক খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা স¤প্রসারণের পর থেকেই বেশি উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক সার প্রয়োগ, সেচযন্ত্রের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার, রপ্তানি বাজারের জন্য বেশির ভাগ জমি খাদ্য উৎপাদনের আওতায় চলে আসে। ফলশ্রুতিতে বাণিজ্যিক কৃষিখাত বর্তমানে প্রায় ৪৪-৪৭% গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে যা জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের খাদ্য অধিকারকে বিপন্ন করেছে। বলা হয়, কৃষিকে পুনঃগঠন ও সংস্কার করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রকট আকারে দেখা দেবে, যা বিশ্বের আরও কোটি কোটি মানুষের খাদ্য অধিকারসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারকে বিপন্ন করবে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বায়ুমণ্ডলে মাত্রাতিরিক্ত গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং একে কেন্দ্র করে বিশ্বে উৎপাদনব্যবস্থা থেকে শুরু করে নানামূখী সমস্যা তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিক কৃষির কারণে মাটির উর্বরাশক্তি ক্ষয় হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন আরও দ্রুতভাবে সংঘটিত হচ্ছে। তবে বাণিজ্যিক কৃষির কারণে মাটির জৈব পদার্থ হ্রাসের মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে মাটি নিজে ভূমিকা রাখতে পারে। কেমন করে? বলা হয়, মাটি যে পরিমাণ জৈব উপাদান হারিয়েছে সেই পরিমাণ জৈব পদার্থ যদি পুনরায় মাটিতে প্রতিস্থাপন করা যায় তাহলে বায়ুমণ্ডলে যে অতিরিক্ত কার্বণ রয়েছে সেগুলোর এক তৃতীয়াংশ শোষণ করা যাবে। এই প্রক্রিয়াটি যদি অব্যাহত রাখা হয় তাহলে আগামী ৫০ বছরে বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বনের দুই তৃতীয়াংশ শোষণ করা সম্ভব হবে যা একদিকে মাটির উর্বরাশক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনও প্রশমন করা যাবে।
মধ্য উন্নিশ শতকের দিকে জার্মান রসায়নবিদ Justus Von Liebieg গবেষণা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, মাটিতে উদ্ভিদ মাত্র তিনটি উপাদান গ্রহণ করে; যথা নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম। তবে পরবর্তীতে তিনি স্বীকার করেছেন যে, এই তিনটি উপাদান ছাড়াও উদ্ভিদ মাটি থেকে আরও অনেক রকম উপাদান গ্রহণ করে। মূলত তার এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই বাণিজ্যিক কৃষি সূত্রপাত হয়; যা এ তিনটি উপাদান দিয়ে কৃত্রিমভাবে সার তৈরি করে মাটিতে প্রয়োগ করা হয় বেশি উৎপাদনের জন্য।
আসলে বাণিজ্যিক কৃষির চর্চার পর থেকে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণ কার্বন জমা হচ্ছে। এই সব সঞ্চিত কার্বন শোষণ করার মতো কোন ব্যবস্থা না থাকায় জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বাণিজ্যিক কৃষি নানাভাবে কার্বন নিঃসরণ করছে। জৈব কৃষির পণ্ডিতরা বলেছেন, ১৯৬০ সাল থেকে প্রতি হেক্টরে মাটির নাইট্রোজেন গ্রহণের মাত্রা ৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে মাটিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে। কিন্তু অতিরিক্ত এই নাইট্রোজেন উদ্ভিদকনায় না পৌছে বায়ুমণ্ডল বা ভূ-গর্ভস্থ পানিতে নিঃশেষিত হয়ে যায়। তাই যত বেশি নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করা হয় তত বেশি এটি অকার্যকর হয়। মাটি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং কৃষকরা অনেকদিন থেকেই বলে আসছেন যে, রাসায়নিক সার মাটির উর্বরাশক্তি নষ্ট করে মাটির জৈব উপাদানকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে। মাটিতে যখন রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয় তখন দ্রবনীয় পুষ্টি হঠাৎ করে প্রচুর পরিমাণে দেখা দেয়। এটি মাটিতে অণুজীবের জৈবিক ক্রিয়া দ্রুত গতিশীল ও বৃদ্ধি করতে থাকে। এই বর্ধনশীল জৈবিক কার্যক্রম অণুজীবের জৈব পদার্থ গ্রহণের মাত্রাকে বৃদ্ধি করার মধ্য দিয়ে বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্তি কার্বন ছেড়ে দেয়। আবার সারের মধ্যে পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি কমে গেলে অনেক অণুজীব মারা পড়ে। এতে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমতে থাকে।
যেহেতু প্রায় দু’দশক ধরেই বাণিজ্যিক কৃষির বদলতে মাটিতে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ চলে আসছে স্বাভাবিকভাবে এটি অনুমেয় যে, মাটিতে জৈব পদার্থের উপাদান ও পুষ্টি অনেকটা কমে গেছে। মাটি এতে ঘন হচ্ছে; এর পানি ও রস শুষে নেওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে। উদ্ভিদের শেকড় কম হওয়ায় পুষ্টি গ্রহণ ও শোষণ করার ক্ষমতা কমে যায়। এভাবে সারে যে পরিমাণ পুষ্টি আছে সেগুলো ধীরে ধীরে কম কার্যকর হচ্ছে কারণ উদ্ভিদ এই পুষ্টি গ্রহণে কম ক্ষমতাসম্পন্ন হচ্ছে। তাই এর সমাধান হিসেবে সারের প্রয়োগের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করতে হয়; যা সমস্যা তো সমাধান তো নয়ই বরং সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। কারণ রাসায়নিক সারে যে নাইট্রোজেন রয়েছে সেগুলো মাটিতে স্থানান্তরিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে নাইট্রাস অক্সাইড হিসেবে নিঃসরিত হয়। নাইট্রাস অক্সাইড কার্বনের চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি গ্রীন হাউস গ্যাস প্রতিক্রিয়া রয়েছে এবং বর্তমানে কৃষিখাতে গ্রীণ হাউস প্রতিক্রিয়ার কারণে এটি ৪০ শতাংশ দায়ী। এছাড়া এটি খুব দ্রুতলয়ে ওজন স্তরকে ক্ষতিসাধন করে। রাসায়নিক সার অনেক সময় উদ্ভিদকনাকে এসিডিফাই করে, যা মাটির জৈব উপাদান ও পুষ্টি বৃদ্ধিকারী বিভিন্ন অণুজীবকে হত্যা করে।
একটি স্বাস্থ্যকর মাটি থেকে উদ্ভিদকনা প্রায় ৭০ থেকে ৮০ বিভিন্ন রকমের পুষ্টি গ্রহণ করে থাকে। এ স্বাস্থ্যকর মাটি প্রাণী ও উদ্ভিদকনার বিভিন্ন অবশিষ্টাংশ দ্বারা গঠিত। মাটিকে স্বাস্থ্যকর ও সতেজ করে তুলতে হলে এতে জৈব উপাদান ও পুষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি করা জরুরি। জৈব কৃষি অনুশীলন ও শস্য বিন্যাসের মাধ্যমে মাটি নিজেই অনেক কার্বণ শোষণ করে যা জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমন ভূমিকা রাখতে পারে এবং একই সাথে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করার মধ্য দিয়ে মাটিকে উৎপাদনশীল করে তুলে।