কৃষকদের পাশে দাঁড়াই
বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।’ কৃষক ও কৃষিই একটি দেশের আশা ভরসার ক্ষেত্র। অতীত থেকে বর্তমান অবধি কৃষকরা তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টায় সবার জন্য খাদ্যর যোগান দিয়ে থাকেন আমরা সবাই সে কথা জানি। কৃষক ও কৃষি নিয়ে অনেক গান কবিতা থাকলেও কৃষক এখন সবার হতে পারেনি। কারণ একটি সময়ে আমরা কৃষকের কথা বারেবারে স্মরণ করলের যখন কৃষকের প্রয়োজন তখন আমরা তাঁদের কথা ভুলে যাই। কৃষক তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না, উৎপাদন খরচ বেশি আবহাওয়াগত সমস্যাসহ নানা সমস্যার মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে প্রতিনিয়তই।
বর্তমান সময়ে কৃষকরা আমন ধান সংগ্রহ নিয়ে ব্যস্ততম সময় অতিবাহিত করছেন। আমরা পত্রিকা, টিভি চ্যানেল খুলেই দেখতে পাচ্ছি ‘এবার আমনের ফলন বাম্পার হয়েছে কিন্তু দাম নিয়ে হতাশ কৃষক’ বা ‘ধানের দামে কৃষকরে হতাশা কাটছে না’ ইত্যাদি শিরোনাম। কৃষক তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের দাম নিয়ে যত হতাশ হয় তা আর বাংলাদেশের অন্য কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় না। কৃষক এই আমন ধান তুলেই তাঁর উৎপাদন খরচ মেটায়, সাথে মেটায় তাঁর পরিবারের বিভিন্ন চাহিদা। আবার রবি মৌসুমের ফসল রোপণ বপনের কাজ। জমি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপকরনের দাম ঠিক থাকলেও কৃষকের ধানের দামের ঠিক নেই। কৃষক বাধ্য হয়ে অল্পদামে তাঁদের ধান বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে মহাজনের চাপে। কারণ মহাজন ঠিক থাকলে পরবর্তীতে তাঁরা অন্য ফসল চাষ করতে পারবেন। এ বিষয়ে রাজশাহী জেরার তানোর উপজেরার দুবইল গ্রামের কৃসক মোঃ লিয়াকত আলী (৪৭) বলেন, ‘আমাদের মত কৃষকরা আমন ধান তুলেই বিক্রয় করি। কারণ রবি মৌসুমের ফসল চাষের প্রস্তুতি নিতে হয়, মহাজনের দায় মেটানোসহ পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য। এই চাপে আমরা কম দামে ধান বিক্রয় করতে বাধ্য হই।’ তিনি হতাশা নিয়ে আরো বলেন, ‘ধানের দাম ঠিকই বাড়বে যখন আমাদের হাতে আর ধান থাকবে না। আমাদের দেখার কেউ নেই।’
বর্তমান সময়ে পেঁয়াজ বাংলাদেশের সব মানুষের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাইনে দাঁড়িয়ে পুলিশি পাহাড়ায় মানুষ পেঁয়াজ কিনছেন। কিন্তু এই কৃষিপণ্য পেঁয়াজই আজ কৃষকের ধরাছোয়ার বাইরে চলে গেছে। কারণ কৃষক আর পেঁয়াজ কিনতে পারছেন না। পেঁয়াজের দাম বেশি হলেও এর থেকে একটি পয়সা লাভও কৃষক আর পাবেন না, যদিও এই পেঁয়াজ উৎপাদন করতে কৃষকেরই শ্রমে ঘাঁমে একাকার হয়েছিল। কিছু না করেও অসাধু শ্রেণীর কিছু মানুষ কৃষককে ঠকাতে ব্যস্ত, ঠকাতে ব্যস্ত সাধারণ মানুষকে। হ্যাঁ, এই পেঁয়াজও সবার নাগালে চলে আসবে ঠিকই যখন কৃষক তা জমি থেকে পেঁয়াজ তুলে বিক্রয় শুরু করবেন। কারণ কৃষক যদি লাভবান হয় তাহলে যে অসাধু মধ্যসত্বভোগীরা লাভবান হবে না। এ বিষয়ে জেলার গোকুল-মোথুরা গ্রামের কৃষক শ্রী জীতেন্দ্রনাথ সূত্রধর বলেন, ‘এক মণ ধান ছয়শত টাকায় বিক্রয় করেও পরিবারের জন্য ভালো কোন বাজার করা সম্ভব হয় না। আবার যেদিন পেঁয়াজ কিনতে হয় সেদিন আরো এক মণ ধান বাজারে বিক্রয় করতে হয়। কারণ পেঁয়াজ ২৪০ টাকা। শহরাঞ্চলে সরকারিভাবে পেঁয়াজ বিক্রয় হলেও গ্রামে এর কোন ব্যবস্থাই নেই।’ এখানেও কৃষককে আমরা আপন করতে পারলাম কই।
জাত বিশেষে আলু এখন ৩০-৪০ টাকা কেজিতে বিক্রয় হচ্ছে কিন্তু এই আলুই যখন কৃষকের জমি থেকে তোলা হয় তখন ৬-১০ টাকায় বিক্রয় হয়। সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য চাষ উপকরণের দাম ঠিক থাকলেও ঠিক থাকে না শুধু কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের। কৃষকে সাময়িক সংকটে ফেলে তাঁর ফসলের গোলা শুন্য করা হয়। এরপর কৃষকেই নিজের পণ্য বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য করা হয়। বিভিন্ন বীজ কোম্পানি তাঁদের বীজ বিক্রয়ের টার্গেট পূরণ করে তাঁদের কর্মী বাহিনীকে নিয়ে অবকাশের জন্য নিয়ে যায় বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় ঠিক তখন একজন কৃষক হিসাব মেলায় কয় মণ ধানে এবার আমার ছেলের এসএসসির ফর্ম ফিলাপ হবে বা আমার হালের গরু বিক্রয় করে দেনা শোধ না করলে মহাজন এবার আমাকে আর সার বীজ দিবে না।
কৃষককে নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা ও কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের যদি সঠিক মূল্য দিতে না পারা যায় কৃষকের এ হতাশা কাটানো সম্ভব হবে না। কৃষককে নিয়েই তাঁদের সমস্যাগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের এ হতাশা কাটানো সম্ভব। তা না হলে সার, বীজ, জমি, কৃষককের উৎপাদিত পণ্য যেমন অন্যের হাতে চলে গিয়েছে তেমনই ব্যক্তি কৃষক একসময় অন্য পেশায় চলে দিয়ে এ সংকটকে আরো ঘনিভূত করে তুলবে। তাই এখনই সময় কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর। আসুন আমরা কৃষকের পাশে দাঁড়াই, কৃষিকে বাঁচাই। কৃষি বাঁচলে তো আমরা সবাই বাঁচবো।