হাওরে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ: ভূমিহীন একজন কৃষকের সমৃদ্ধির কথা

নেত্রকোনা থেকে সুমন তালুকদার

বাংলাদেশ নদী-নালা ও হাওরের দেশ। বাংলাদেশে মেটি ৪২৩টি হাওর রয়েছে এবং মোট ভূ-খন্ডের ৭ ভাগজুড়ে হাওরের অবস্থান। যার সবগুলোই নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলায়। নেত্রকোনা জেলায় মোট হাওরের সংখ্যা রয়েছে ৮১টি। নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি, মদন, মোহনগঞ্জ, কেন্দুয়া ও কলমাকান্দা উপজেলায় হাওরগুলো অবস্থিত। তবে খালিয়াজুড়ি উপজেলাটির চারিদিক হাওরবেস্টিত।


হাওরের কৃষিজমি বছরের বৈশাখ-কার্তিক পর্যন্ত প্রায় ৬/৭ মাস (বৈশাখ-অগ্রাহায়ন) পানিতে তলিয়ে থাকে। বোরো ধান ছাড়া অন্য কোন ফসল চাষ হয় না। কিছু কিছু উঁচু জমি থাকলেও সেগুলো শুধু ধান মাড়াই ও শুকানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। সেখানে সাধারণত হাওরবাসীরা অন্য কোন ফসল চাষ করেন না। তাদের বিশ্বাস হাওরের জমিতে ধান ছাড়া অন্য কোন ফসল হয় না। তাই বোরো মৌসুমের খলার জন্য ফেলে রাখা উঁচু জমিতে অন্যান্য ফসল চাষ করা গেলেও তারা তা করেন না। হাওরাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত উঁচু কৃষিজমিতে প্রচুর আগাছা হয়। বাছাই করেও আগাছা দমন করা সম্ভব হয় না। আগাছা বাছাইয়ের জন্য অনেক শ্রমিক ও শ্রমিকের মজুরির প্রয়োজন হয় এবং ফসলের রোগবালাই দমনে সার, কীটনাশক ক্রয় ও সেচের খরচসহ উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হয় এবং সে তুলনায় লাভ খুব কম হয়। তবে হাওরাঞ্চলে বেশকিছু কৃষক রয়েছেন যারা কর্মসংস্থানে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বৈচিত্র্যময় ফসলের চাষাবাদ দেখে এসে নিজ গ্রামে ছোট আকারে সবজিসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করে সফলতা পেয়েছেন।
মানুষ বিভিন্নভাবে দক্ষতা অর্জন করে। বিশেষভাবে বই পড়ে, শুনে, দেখে ও সরাসরি হাতে কলমে চর্চা করে। দেখে ও সরাসরি হাতে কলমে কাজের অভিজ্ঞতা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে যে কেউ সহজেই উন্নতির শিখরে পৌছাতে পারেন। পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম ও নতুন নতুন নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবন ও স্থানীয় সম্পদ ব্যবহারের মানসিকতা ও কৌশল জানা থাকলে তার উন্নয়ন অবশ্যাম্ভাবী। বাংলার গ্রামেগঞ্জে এমন অনেক কৃষক-কৃষাণী রয়েছেন, যারা কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় ও নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তিতে প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে সাফল্য পেয়েছেন। আজ হাওরের এমনই একজন কৃষকের সফলতার কাহিনী তুলে ধরছি যিনি নিদারুণ আর্থিক সংকট, কর্মহীনতা ও সাংসারিক খরচ মেটাতে না পেরে ভাগ্যান্বেষণে নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র কৃষিশ্রমিক হিসাবে কুড়ি বছর কাজ করার পর পুনরায় গ্রামে ফিরে পরিশ্রম, বুদ্ধি ও স্থানীয় সম্পদ ব্যবহারের কৌশল আয়ত্ব করে কৃষিশ্রমিক ও ভ্রাম্যমান সবজি বিক্রেতা থেকে আজ সফল কৃষকে পরিণত হয়েছেন। তিনি নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার হাওর বেষ্টিত মেন্দিপুর ইউনিয়নের নূরপুর বোয়ালি গ্রামের কৃষক মো. তাজুল ইসলাম। স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান (৩ মেয়ে ও ২ ছেলে) নিয়ে তাজুল ইসলাম দরিদ্র পরিবার। পৈত্রিক সম্পত্তি বলতে শুধুমাত্র বসতভিটার ১২ শতাংশ জমি, যার মধ্যে পিতা-মাতা ও তিন ভাইয়ের বসতবাড়ি। নিজস্ব চাষের কোন জমি নেই।

জীবনের পথপরিক্রমা
২০১১ সালে গ্রামে ফিরে ভূমিহীন তাজুল ইসলাম পার্শ্ববর্তী উপজেলা ১৫ কি.মি. দূরের কেন্দুয়া বাজার থেকে সবজি কিনে নিজের রিক্সাভ্যানে গোবিন্দশ্রীসহ হাওরের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে যে সামান্য লাভ পেতেন তাই দিয়েই কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এভাবে তিন বছর ভ্যানে ফেরি করে সবজি ব্যবসার পর তিনি নিজেই নানা ধরনের সবজি চাষের সিদ্ধান্ত নেন। পৈতৃকসূত্রে বা নিজের কোনো জমি না থাকায় গ্রামের একজন ধনী ব্যক্তি যিনি শহরে বসবাস করেন এমন একজনের অব্যবহৃত পতিত ৬০ শতাংশ জমি চেয়ে নিয়ে ২০১৩ সালে তিনি হরেক রকমের সবজি চাষ শুরু করেন। ভালো লাভ হওয়ায় তাজুল ইসলাম পরবর্তী বছর সবজি বিক্রির আয়ের টাকায় ১.৮০ একর জমি বন্ধক নিয়ে পুরোদমে সবজি চাষ শুরু করেন। এভাবে তিনি প্রতি বছর মৌসুম ভিত্তিক জমি বন্ধকী ও লিজ নিয়ে সবজি চাষের জমির পরিমাণ বাড়াতে থাকেন। ২০১৯-২০২০ রবি মৌসুমে তিনি মোট ২২ কাঠা (২.২ একর) জমি বন্ধকী ও লিজ নিয়ে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেছেন।


আন্তঃফসল ফসল চাষাবাদ: পরিকল্পিত কৃষির অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত
প্রাকৃতিকভাবে হাওরাঞ্চলের জমিতে প্রচুর আগাছা জন্মে। আগাছা বাছাইয়ের জন্য অনেক শ্রমিক প্রয়োজন হয়। উৎপাদন খরচ বেশি হয়। তাই আগাছা দমন না করে বরং আগাছা জন্মানোর সুযোগ না দিয়ে তিনি মূল ফসলের সাথে একত্রে আরও ২/৩ জাতের স্বল্প মেয়াদী সবজি চাষ করেন। জমিতে মূল ফসল রোপণ বা বপনের কিছু দিনের মধ্যেই তিনি অন্যান্য ফসলের বীজ বপন করেন। যেমন- তিনি সারি আন্তঃফসল হিসাবে ফুলকপি, বাঁধাকপিও বাটিশাক চারার ফাকে ফাকে লালশাক, পালংশাক, ডাটাশাক, মূলা শাক ও মরিচ চারা রোপণ করেন। বাঁধাকপি বা ফুল কপির জমিতে সারি আন্তঃফসল হিসেবে লালশাক বা পালংশাক চাষ করায় ফুলকপি বা বাঁধাকপির ক্ষতিকারক পোকামাকড় এর গন্ধ সহ্য করতে না পেরে জমিতে ঢুকতে পারে না। বাঁধাকপির ক্ষেতে মরিচ, মূলা, লালশাক, ডাটা ও টমাটো চাষ করায় মরিচের গোড়া কাটা পোকা ও বাঁধাকপির গোড়া পঁচা রোগ ও পাতা খাওয়া লেদা পোকার আক্রমণ হয়নি। সারি আন্তঃফসল তুলে ফেলার পর বাঁধাকপি ও ফুলকপিতে কোন রোগবালাইয়ের আক্রমণ হয়নি। সারি আন্তঃফসলের জমি আচ্ছাদিত থাকায় জমিতে ঘাস জন্মাতে পারে না। তেমনি ফসলে পোকামাকড়েরও আক্রমণ হয় না। এর ফলে কীটনাশক ক্রয় ও আগাছা বাছাইয়ের জন্য শ্রমিক বাবদও কোন খরচ হয়না এবং পরিবেশ দূষণ রোধ হয় ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষিত থাকে। আন্তঃফসল ফসলের উপর রাতের কুয়াশা পড়ে মাটি ভিজে অনেকটা সেচের কাজ করে, ফলে কম সেচের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে মূল ফসলের অর্ধেক সময়ের মধ্যে আন্তঃফসল বিক্রি করে উৎপাদন খরচের সমস্ত টাকা উঠার পর অনেক লাভ হয়।

তিনি সবসময়ই সারি আন্তঃফসল অনুসরণ করেন। তাই একটি ফসল সংগ্রহের পর পুনরায় জমি চাষ করে অন্য ফসলের বীজ বা চারা রোপণ না করে তিনি সব সময় একটি ফসল চাষের মাঝামাঝি সময়ে অন্য একটি ফসলের চারা তৈরি করেন। প্রথম ফসলের ফলন আরম্ভ হলেই সেই ফসলের চারা প্রথম ফসলের সারির মাঝে রোপণ করেন। প্রথম ফসল সংগ্রহের পর দ্বিতীয় ফসল পুরো জমি ছেয়ে যায়। তিনি ২০১৯-২০২০ রবি মৌসুমে ২০ শতাংশ ফুলকপি জমিতে সারি আন্তঃফসল হিসাবে ডাটা এবং একই পদ্ধতিতে অপর ২০ শতাংশ জমিতে বাঁধাকপির সাথে লালশাক চাষ করে ২০ শতাংশ জমি থেকে প্রায় ৮০০০ টাকার ডাটা এবং অন্য ২০ শতাংশ জমি থেকে ৬০০০ টাকার লালশাক বিক্রি করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি বাঁধাকপির ক্ষেতে প্রায় শতাধিক মিষ্টিকুমড়ার চারা তৈরি করে পরবর্তীতে ফুলকপির ও বাঁধাকপি ক্ষেতে রোপণ করবেন। ফুলকপির গাছে ফুল আসা এবং বাঁধাকপি বাঁধতে আরম্ভ করলে তিনি ফুলকপি ও বাঁধাকপির মাঝে সারি করে ৬/৬ ফুট দূরত্বে একই গর্তে দু’টি করে মিষ্টিকুমড়ার চারাগুলো রোপণ করেছিলেন। কপি বিক্রি শেষ হলে মিষ্টিকুমড়ার লতায় সমস্ত জমি ভরে যায়। মিষ্টিকুমড়ার জন্য নিজের শ্রম ছাড়া (চারা রোপণের জন্য) তার কোন খরচ হয়নি। নিজ পরিবারে খাওয়ার পরও মিষ্টিকুড়া পেয়েছিলেন প্রায় আড়াই শতাধিক, যা তিনি ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। ২০১৮-২০১৯ রবি মৌসুমেও তিনি ৫০ শতাংশ জমিতে বাটিশাকের ক্ষেতে (বাটিশাক ১০ হাজার, খিরা (৩৫ হাজার টাকা বিক্রি করেন) এবং পরে মিষ্টিকুমড়া চাষ করে ৮০০টি মিষ্টিকুমড়া পাকিয়ে প্রায় ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। বর্ষা মৌসুমজুড়ে তিনি ক্ষেতের মিষ্টিকুমড়া বিক্রি করেছেন। তিনি ফসল উৎপাদন নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা করেন। তিনি মিষ্টি আলু, গোল আলুর মত উঁচু বেড (রিজ) বানিয়ে চাষ করেছেন। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অনেকগুণে ভালো দেখাচ্ছে বলে তিনি জানান।

চলতি রবি মৌসুমে (২০২০-২০২১) তিনি নিজস্ব ৩০ শতাংশ ও লিজ নেয়া ১০ শতাংশসহ মোট ৪০ শতাংশ জমিতে আন্তঃফসল অনুসরণ করে বৈচিত্র্যময় সবজি ও মসলা ফসল চাষ করেছেন এবং হাওরের ৬ একর জমিতে (বন্ধকী ৩.৬ একর ও লিজ ২.৪ একর) ধান চাষ করেছেন। চলতি রবি মৌসুমে তথ্য সংগ্রহকালীন সময় পর্যন্ত (জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত) তিনি ৪০ শতাংশ জমিতে উৎপাদিত সবজি পরিবারে খাওয়ার পর প্রায় ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। টমাটোসহ এখনও জমিতে অনেক সবজি রয়ে গেছে বলে তিনি জানান। শস্য পর্যায় ও আন্তঃফসল পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনি এ জমিতেও বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করছেন।

ফসল রক্ষায় ঘাস সংরক্ষণ: প্রকৃতিবান্ধব কৃষিচর্চা
সাধারণত কৃষকরা জমি প্রস্তুতির সময় আগাছা ভালোভাবে বাছাই করে ফসলের বীজ বপন বা চারা রোপণ করেন। চাষাবাদকালীন সময়ের মধ্যেও কয়েকবার জমির আগাছা বাছাই করে দিতে হয়। আবার লতা জাতীয় ফসল জন্য মাচা দিতে হয়, যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়। তাজুল ইসলাম জমিতে মাচা না দিয়ে বরং ঘাস জন্মাতে দেন। জমি প্রস্তুতির পর লতা জাতীয় ফসল খিরা ও লাউ রোপনের জন্য গর্ত করে তাতে জৈব সার পরিমাণমত মিশিয়ে বীজ রোপণ করেন। বীজ অঙ্কুরোদগম হয়ে লতানোর সময় পর্যন্ত জমিতে বাদলা ঘাসে ছেয়ে যায়। এসময় কৃষক তাজুল ইসলাম সমস্ত জমির আগাছা পরিষ্কার না করে শুধুমাত্র খিরা গোড়ার এক বর্গফুট ও লাউ গাছের গোড়ার দুই বর্গফুট অংশের আগাছা পরিষ্কার করে দেন। ফলে খিরা ও লাউয়ের লতাগুলো ঘাসের উপর ছড়িয়ে পড়ে ফুল ও ফল দিতে থাকে। তার খিরা ও লাউয়ে জমিতে এতই পরিমাণে ঘাস জন্মে যে, দেখে মনে হয় তিনি জমিতে ঘাস চাষ করছেন। এ বিষয়ে কৃষক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ফল জাতীয় সবজি পোকামাকড় ও পাখি দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষভাবে ফল ছিদ্রকারী পোকা/মাছি ও বুলবুলি পাখির আক্রমণ থেকে খিরা, লাউ ও মিষ্টিকুমড়া রক্ষায় আমি জমিতে বাদলা ঘাস বড় হতে দিই। ফসলের জমিতে ঘাস রাখার ফলে ফসলের কোন ক্ষতি হয় না এবং ফলের রং ভালো হয়। খিরা ফল ঘাসের মধ্যে ঢেকে থাকায় বুলবুলি পাখি আক্রমণ করতে পারেনা এবং খিরার রং ও আকার ভালো হয়। ঘাসের মধ্যে ডুবে থাকায় লাউ ও মিষ্টি কুমড়াও ফল ছিদ্রকারী পোকা বা মাছি পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় এবং রং সুন্দর হয়।’ তিনি ঘাস নাই এমন ফাঁকা জায়গায় থাকা লাউ ও মিষ্টিকুমড়ার কড়া পাতা দিয়ে ঢেকে দেন। ঘাসের মধ্যে ও পাতায় এসব ফল ডুবে থাকায় শত্রু পোকা, মাছি ও পাখি ফলগুলো দেখতে পায়না বলে কোন ক্ষতি করতে পারেনা। তবে জমির সম্পূর্ণ ফসল ওঠার পর এসব ঘাস আমি কেটে গরুকে খাওয়ান।

মাটির উর্বরতায় সাশ্রয়ী স্থানীয় সম্পদ
কৃষক তাজুল ইসলাম জমিতে বেশি করে জৈব সার ব্যবহার করে থাকেন। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে পানিতে ভেসে আসা জার্মুনি পানা ধরে রাখেন। তিনি গ্রামের পাশের পচা ডোবা থেকে জার্মুনি পানা সংগ্রহ করে বাড়ির পাশে রাস্তার ধারের জমিতে বড় গর্ত করে সেগুলো গর্তে ভরে তাতে খড় পোড়া ছাই মিশিয়ে পঁচিয়ে জৈব সার তৈরি করেন। তিনি গরুর গোবর জ্বালানি তৈরি না করে সার হিসেবে জমিতে ব্যবহার করেন। বেশি পরিমাণে জৈবসার ব্যবহারে ফসলে রোগবালাইয়ের আক্রমণও তেমন হয়না। ফসলের রোগবালাই দমনে তিনি খড় পোড়ানো ছাই ব্যবহার করেন। ফসলের গোড়া পঁচা রোগ দেখা দিলে তা নিয়ন্ত্রণে জৈব ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেন। কোনরূপ রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না। তার উৎপাদিত সবজি অনেক নিরাপদ ও সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে চাহিদাও অনেক।

নিজের হাতে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ
বাজারের বীজে অনেক ক্ষেত্রে অংকুরোদগমের হার কম হয়। কৃষক তাজুল ইসলাম বৈচিত্র্যময় সবজি বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করেন নিজের প্রয়োজনে। তিনি খিরা, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, ডাটা, লালশাক, শিম, ঝিঙ্গা, ফরাস, বরবটি, করলা, বেগুন, মিষ্টি আলু ও ধনিয়া বীজ সংরক্ষণ করেন। ক্ষেতের সুস্থ, সবল ও রোগবালাইমুক্ত দাগহীন ফল নির্বাচন করে ফল বা বীজ পাকলে সে ফল/বীজ সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করে রোদে শুকিয়ে বয়ামে বায়ুরোধী অবস্থায় সংরক্ষণ করেন। তিনি প্রতি মৌসুমে অনেক কৃষককে বীজ দিয়ে সহযোগিতা করেন। তার মতে, কৃষকের বাজারের বীজের উপর নির্ভর না করে সময়মত চাষের জন্য নিজেদের চাষের জন্য বীজ সংরক্ষণ করা উচিত। প্রতিবছর তিনি গ্রামের অনেক কৃষক-কৃষাণীর মধ্যে বৈচিত্র্যময় সবজি বীজ বিনামূলে বিতরণ ও বিনিময় করেন। তিনি কোন বীজ বিক্রি করন না। তবে কেউ/কোন প্রতিষ্ঠান বীজের চাহিদা জানালে মাঝে মাঝে সামান্য পরিমাণে বীজ বিক্রিও করে থাকেন।

পরিশ্রম আর সাধনায় সমৃদ্ধি
সবজি চাষের আয় দিয়ে তাজুল ইসলাম ভূমিহীন থেকে ৩.৬ একর বন্ধকী (দুই লাখ টাকা) ধানি জমি এবং ৩ কাঠা বা ৩০ শতাংশ জমির (চল্লিশ হাজার টাকায় সাব কওলা) মালিক হয়েছেন। ২২ হাজার টাকা ২.৪০ একর ধানি জমি এক মৌসুমের জন্য এবং তিন হাজার টাকায় ১০ শতাংশ সবজি জমি লিজ নিয়েছেন। চলতি বোরো মৌসুমে তিনি মোট ৬.০০ একর জমিতে (বন্ধকী ৩.৬ একর ও লিজ ২.৪ একর) ধানের চাষ করেছেন। সবজি চাষ করেছেন ৪০ শতাং জমিতে (নিজস্ব ৩০ ও ণিজ ১০ শতাংশ) সবজি চাষে গোবর সারের উপকারীতার কথা মাথায় রেখে তিনি একটি গরু কেনেন, যা থেকে বর্তমানে তিনটি গরু হয়েছে। সবজি চাষের আয় দিয়ে একটি টিনের ঘর তৈরি করেছেন এবং এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন প্রায় দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে। বাকী চার ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পড়াচ্ছেন।

প্রতিবছর বোরো ধান ও সবজি চাষে তার মোট খরচ হয় প্রায় এক লাখ টাকা। আবহাওয়া ভালো থাকলে কৃষি থেকে (বোরো ধান ও রবি ফসল) বাৎসরিক গড় আয় (সমূদয় খরচ বাদে) প্রায় দুই লক্ষ বিশ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা। সবজি চাষের মাধ্যমে পরিবারের স্বচ্ছলতা আসায় সমাজে তাজুল ইসলামের সুনাম, সন্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি গ্রামের মসজিদ কমিটির অন্যতম সদস্য এবং ডোনার হিসেবেও সকলের সুনাম কামিয়েছেন। তিনি স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যও।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রায় সময়ই তার সবজি ক্ষেত পরিদর্শন করেন। তবে উপজেলা কৃষি বিভাগের সাথে নিজে থেকে তেমন কোন যোগাযোগ না করলেও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তরাই প্রয়োজনে তার সাথে যোগাযোগ করেন। কৃষি বিভাগ থেকে তিনি উন্নত পদ্ধতিতে ধান ও সবজি চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও পার্শবর্তী ইউনিয়ন ও গ্রামের অনেক কৃষক তার সবজি ক্ষেত পরিদর্শন করেছেন। বিভিন্ন মৌসুমে তিনি বারসিক থেকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ বিষয়ে পরামর্শ, বীজ সংরক্ষণ এবং সবজি ও শস্য ফসলের বীজ সহায়তাসহ কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনের জন্য উপকরণ (সিমেন্টের রিং, পালিথিন শীট, বাঁশ ও কেঁচো) সহযোগিতা পেয়েছেন। কৃষি কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি কৃষি বিভাগ থেকে নেত্রকোনা জেলায় শ্রেষ্ঠ মিষ্টিকুমড়া চাষি হিসেবে সন্ম§াননা পেয়েছেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘বারসিক’ থেকে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ, বীজ সংরক্ষণ ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে অবদানের জন্য কৃষি সন্মাননা পেয়ছেন।
‘জিরো থেকে হিরো’ কথাটির অন্যতম উদাহরণ কৃষক তাজুল ইসলাম। কৃষক তাজুল ইসলামের ন্যায় হাওরাঞ্চলের সকল দরিদ্র কৃষক ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠী তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা খাটিয়ে কঠোর পরিশ্রম ও একনিষ্টতার সাথে চেষ্টা করলে দারিদ্রতা থেকে নিশ্চিত মুক্তি পাবে এবং পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে সক্ষম হবে। কৃষক তাজুল ইসলাম তাদের জন্য উদাহরণ ও পথ প্রদর্শক হয়ে থাকুক।

happy wheels 2

Comments