হাওরের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় জলবায়ু যুব ক্যাম্প অনুষ্ঠিত
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
গোবিন্দশ্রী তলার হাওর কৃষক সংগঠন, বালইপাড়ের যুব সংগঠন ও উচিতপুর আলোর দিশারী যুব সংগঠনের উদ্যোগে গতকাল গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স প্রাঙ্গনে হাওরের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় জলবায়ু যুব ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়েছে। গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ.কে.এম. নূরুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে প্রায় ছয় শতাধিক লোকের অংশগ্রহণে জলবায়ু যুব ক্যাম্পে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করে মদন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান মাষ্টার। অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নেত্রকোনা জেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বাবু শ্যামলেন্দু পাল ও উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আবদুল আহাদ।
দিনব্যাপী হাওর জলবায়ু যুব ক্যাম্পের অনুষ্ঠানটি আলোচনা সভা, কুই-কুইজ প্রতিযোগিতা, স্টল প্রদর্শন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কৃষিতে অবদানের জন্য কৃষক-কৃষাণীদের সম্মাননা প্রদান এবং স্থানীয় গ্রামীণ খেলাধুলা আয়োজনের মাধ্যমে ঝাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান মাষ্টার স্থানীয় কৃষি উপকরণ দিয়ে তৈরি তোরণে খড়ের ফিতা কেটে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী শেষে তিনি অন্যান্য অতিথিদের নিয়ে স্থানীয় যুবক-যুবতী, কৃষক ও কৃষাণীদের প্রদর্শিত পাঁচটি স্টল ঘুড়ে দেখেন। পাঁচটি স্টলের মধ্যে ছিল স্থানীয় কৃষি উপকরণ, অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদ, স্থানীয় পিঠা, স্থানীয় শস্য ফসলের বীজ, নেত্রকোনার ৫৭টি নদী ও ৮১টি হাওরের নাম লেখা স্টল। স্টলে প্রদর্শিত উপকরণগুলো দেখে অতিথিগণ তার প্রশংসা করেন। অতিথিগণ পিঠার স্টলে স্থানীয় পাঠা পরখ করে দেখেন।
স্টল প্রদর্শন শেষে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ.কে.এম. নূরুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে এবং মেহেদী হাসান পরশ ও অহিদুর রহমান এর সঞ্চালনায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান মাষ্টার প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চলে যুব ও কৃষক সংগঠনের জলবায়ু যুব ক্যাম্প আয়োজনের প্রশংসা করে বলেন, ‘হাওরাঞ্চলের সাধারণত এধরণের অনুষ্ঠান কেউ আয়োজন করেনা। যুব ও কৃষক সংগঠনগুলো এলাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পেরে আজ হাওর জলবায়ু যুব ক্যাম্প আয়োজন করেছে। হাওরের জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করে জীবনযাপন করেন। কোন কোন কোন ক্ষেত্রে তারা সমস্যাগুলো মোকাবেলায় সফল হয় আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়।’ তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হাওরের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য আজ হুমকির মূখে। রাসায়নিক কৃষি উপকরণ ব্যবহার হ্রাস করে এবং পানি সহনশীল গাছের বনায়ন করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করা সম্ভব। তাই হাওরের জলবায়ুজনিত সংকট মোকাবেলায় হাওরবাসীদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’ তিনি যুব সমাজকে হাওরের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় বনায়নসহ বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানান এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন।
নেত্রকোনা জেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বাবু শ্যামলেন্দু পাল আয়োজক যুব ও কৃষক সংগঠন এবং অংশগ্রহণকারী সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হাওর জলবায়ু যুব ক্যাম্প আয়োজন বর্তমান সময়ের জন্য যথাযথ হয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি অনুষ্ঠান নয়, এর অন্যতম উদ্দেশ্য হাওরের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে হাওরবাসীদের সচেতন করা এবং এগুলো রক্ষায় সকলকে উদ্বুদ্ধ করা। বিশেষভাবে যুব সংগঠনগুলো হাওরের পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যুবকরা হাওরের পানি সহনশীল গাছের বনায়নে বৃক্ষ রোপণ, পাখি নিধন বন্ধ করতে এবং পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় প্রচারণা করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে। কৃষকরা ফসল উৎপাদনে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে পরিমিত ব্যবহারের মাধ্যমে এবং জৈব উপায়ে ও সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হাওরের পরিবেশ (মাটি, পানি, বায়ু ও প্রাণবৈচিত্র্য) রক্ষা করতে পারে।’ তিনি সকলকে হাওরের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতন হয়ে কাজ করার আহবান জানান।
উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আবদুল আহাদ তার বক্তব্যে বলেন, ‘হাওরে এ ধরণের যুব ক্যাম্প হয়তোবা কখনো এর পূর্বে অনুষ্ঠিত হয়নি। যুব ও কৃষক সংগঠনের এধরণের উদ্যোগ গ্রহণ সত্যি প্রশংসনীয়। তবে শুধুমাত্র অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই হাওরের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষিত হবে না। এজন্য এলাকার যুবক, কৃষক ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তাদের সামর্থ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বনায়ন করা, পাখি নিধন বন্ধ করা, বিষ দিয়ে মাছ ধরা, রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈব উপায়ে চাষাবাদের মাধ্যমে হাওরের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে যুব সমাজ ও কৃষক-কৃাণীদেরকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। যুবদেরকে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরী ও দক্ষতামূলক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, তবেই যুবরা নিজেদের যেমন উন্নয়নের পথে চালিত করতে সক্ষম হবে, তেমনি দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।’ তিনি যুবদেরকে কারিগরী ও দক্ষতামূলক শিক্ষা অর্জনের জন্য উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
আলোচনা শেষে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য হাড়ি ভাঙ্গা খেলা, যুবদের জন্যা চোরপলান্তি, শিশুসহ সকল বয়সের নারী-পুরুষদের জন্য হাওর কেন্দ্রিক বিষয়ে কুইজ-কুইজ প্রতিযোগিতা, যুবদের মোরগ লড়াই, নারীদের জন্য চোয়ার দৌড় খেলা ও গ্রামীণ গীতের আয়োজন করা হয়। এছাড়াও হাওরাঞ্চলের কৃষি পরিবেশে বৈচিত্র্যময় সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসল চাষ করে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় বিশেষ অবদানের জন্য দু’জন কৃষক-কৃষাণীকে (একজন কৃষক-২১ জাতের ও একজন কৃষাণী-৪৭ জাতের সবজি ও ফলজ গাছ) হাওর জলবায়ু সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে সভাপতি খেলাধুলায় বিজয়ীদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণ করেন। শেষে সভাপতির সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী হাওর জলবায়ু যুব ক্যাম্পের সমাপ্তি হয়।