সত্যিই এ এক আলোর ভূবন!
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসা আর স্বাভাবিক একটি কাজ হলো আড্ডাবাজি। হঠাৎ করেই ছোটভাই সুবীর মোদক একজনকে নিয়ে আসলো আমাদের আড্ডাস্থলে। নাম তার জাহাঙ্গীর। অনেক লোকের ভীড়ে তাঁর সাথে সেদিন তেমন একটা কথাবার্তা হলো না। তবে তাঁর কথার সারকথা হলো তাদের একটি স্কুল আছে আর আমাকে সেখানে যেতে হবে। যাহোক আমিও কথা দিলাম যাব ঈদের পরে একদিন।
গত ৫ সেপ্টেম্বর আমি, শিমুল (আমার স্ত্রী), সুবীর সকাল বেলায় ধনবাড়ী থেকে রওনা হলাম সেই স্কুল পরিদর্শনের জন্য। ধনবাড়ী থেকে মধুপুর সিএনজি আর মধুপুর থেকে একটি অটো রিকসা করে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। জলছত্র নামের জায়গা থেকে আরো ২/৩ কি: মি: রিকসায় আমরা যেতে লাগলাম। রাস্তার দুধারে সারিসারি শাল গাছ আর তার মধ্যে দিয়ে আনারস বাগান আর সাইকেল ও রিকসায় করে কেউ কেউ আনারস নিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে। একটু মেঘলা আবহাওয়া কিন্তু ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। আমরা অটো রিকসায় কিছুদূর যাবার পর আবার হাঁটা রাস্তা শুরু হলো। কারণ মাটির রাস্তায় রিকসা যাবেনা। আমরা হেঁটে চললাম পাহাড়ি রাস্তার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ জাঞ্জালিয়ার দিকে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আমরা পৌছে গেলাম সেই স্কুলের সামনে। একটি টিনের ঘর জীর্ণ চেহারার। কয়েকজনকে দেখলাম দাাঁড়িয়ে আছে আমাদেরকে বরণ করার জন্য। সবাই আমাদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানালো। জীর্ণ ঘরটি হলো আলোর ভুবন প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই এলাকার ৫/৬ কি: মি: মধ্যে এটি ছাড়া আর কোন স্কুল নেই বলে জানালো স্থানীয় একজন। কথা প্রসঙ্গে একজন জানালো প্রায় ১০ বছর ধরেই তারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এই স্কুলটি চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ ১০০ টাকা, কেউবা ২০০ টাকা আবার কেউ মাসে ৫০০ টাকা করে দেয় স্কুল পরিচালনার জন্য। এভাবেই এই তরুণরা বছরের পর বছর ধরে এই স্কুলটি চালিয়ে যাচ্ছে। আমি প্রশ্ন করলাম এটি কিভাবে সম্ভব হলো?
জবাবে তারা জানালো, ‘আমরা সকলেই মিলে এটিকে সম্ভব করেছি। আর আমাদের আগ্রহ দেখেই স্থানীয় মানুষসহ অনেকেই আমাদের পাশে এসে দাাঁড়িয়েছে। স্থানীয় একজন মানুষ প্রায় দুই বিঘা জমি এই স্কুলকে লিখে দিয়েছে।’ জমি কেন দিলেন? জমিদাতাকে এই প্রশ্ন করলে তিনি স্থানীয় ভাষায় বললেন, “মইরা গেলেতো সব পইরাই থাকবো। পোলাপানগুলা ভালা তাই মনে হইছে একটা ভালা কাম করি। আমি জানি এরা এটারে নিয়া খারাপ কিছু করবো না।”
জাহাঙ্গীর নামের উদ্যোক্তা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম এই কাজের অনুপ্রেরণা কিভাবে পেলে? সে বললো, “আমরা বন্ধুরা মিলেই হঠাৎ করেই এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। শুরুতে কাজটি এতো সহজ ছিল না। আর যে জায়গাটায় এই স্কুল করেছি সে জায়গাটি জঙ্গল ছিল। দিনের বেলাতেও তেমন লোকজন এখানে আসতো না। কিন্তু এখন আশপাশের সকল গ্রাম থেকেই ছেলে মেয়েরা এখানে আসছে লেখাপড়া শিখবে বলে। আর এজন্যই আমরা এই স্কুলটির নাম দিয়েছি আলোর ভুবন স্কুল। এই স্কুল থেকে পড়াশুনা করে এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছেলে মেয়েরা পড়াশুনা করছে। তারা নানানভাবেই এই উদ্যোগের সাথে সম্পর্কিত।”
আলোর ভুবনের আরেক উদ্যোক্তা শুভ জানালো, “এই স্কুলটিকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাজারসহ এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। স্থানীয় সাংসদ স্কুলটির উন্নয়নের জন্যেও অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আর একটি পাকা রাস্তারও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এর ফলে এই জনপদ এখন অপেক্ষাকৃত আলোকিত জনপদ।”
সেদিন স্কুল দেখতে গিয়ে দেখলাম এলাহি কান্ড। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন এলাকার গণ্যমান্য লোকজনদেরও ডাকা হয়েছে স্কুল উন্নয়নে করণীয় নির্ধারণের জন্য। আমাকেও কিছু কথা বলতে হলো। আমি বলার থেকেও দেখে বিমোহিত। যে এক ঝাক তরুণ কি প্রাণদীপ্ত হতে পারে! আনন্দ ভুবন গড়ে তারা এই দেশটিকেই এগিয়ে নিচ্ছে। তাদের এই উদ্যোগ ছড়িয়ে যাক দিকে দিকে। তারা এখন স্বপ্ন দেখে দেশের সকল প্রান্তে এই আলোর ভুবনকে ছড়িয়ে দিতে। আমরাও তাদের এই স্বপ্নে সারথী হতে চাই। দারুণ একটি সময় কাটিয়ে আমরা আবার বাড়ির পথ ধরলাম। মনে মনে গুণগুণ করে গাইতে লাগলাম, “আনন্দ লোকে মঙ্গলালোকে, বিরাজ, সত্য সুন্দরও।”