এখন আর বাদায় যাই নে!
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল :
‘এখন আর বাদায় যাই নে, ভাটা করি, জংগলে আগের মত সেই মজা আর নেই। আগের মত মাছ, শাক মেলে না, জলদস্যুর চাপ বেশি, পাশের রেট বেশি, আবার অফিস থেকে মাঝে মধ্যে পাশ দেয় না, যে কারণে বাদা করা বাদ দে দিছি।’
এভাবেই জানালেন শুশান্ত মন্ডল (৫০)। সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সুন্দরবন সংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীর চরে কলবাড়িতে জেলে পাড়ায় বাস তার। দীর্ঘ ৩৫ বছর সুন্দরবন থেকে মাছ কাঁকড়া সংগ্রহ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। বিগত ৫ বছর তিনি আর বাদায় যান না। এখন বছরের ৬/৭ মাস ইটের ভাটায় থাকে অবশিষ্ট সময়ে শ্রমিক হিসেবে এলাকাতে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে।
বাগদী সম্প্রদায়ের অভাবের সংসারে জন্মগ্রহণ করায় ১০ বছর বয়স থেকেই পিতা নিরঞ্জন জেলের সাথে সুন্দরবনে মাছ ধরার কাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কোন রকমে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠার পরে লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি তাঁর। সুন্দরবনের জল, জাল আর মাছের সাথে জীবন জড়িয়ে ২৫ বছর বয়সে একই জেলে পাড়ার কমলা বানুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরে নিজের সংসার আলাদা করে ফেলেন। সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরে জীবন চলতে থাকে তাদের। সময়ের আলোকে সংসারে ২টি ছেলে সন্তান আসে। স্বল্প আয় ও পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হয়নি দুই সন্তানের। ছোট থেকেই পিতার সাথে বনে মাছ ধরার কাজে সহযোগিত করেন।
এভাবেই কেটে যায় সময়। পরিবেশ প্রতিবেশ আবহাওয়া কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন অথবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে সুন্দরবনের নদীতে মাছের অপ্রতুল্যতা দেখা দিলে সংসারে আয় কমতে থাকে। সংসারে প্রতিদিনের খরচ বাড়লে ও মাছের প্রাপ্তি কমতে থাকে। মাছ ধরে সংসার আর চলেনা ঠিকমত।
‘সুন্দরবনের নদীতে কখনও প্রতিদিন ফিরে আসতাম, কখনও ৩/৪দিন থাকতাম, এই মাছগুলো মুন্সিগঞ্জ কাটায় (অকশনে মাছ ক্রয় বিক্রয়ের আড়ৎ) বিক্রি করতাম। জংগলে মাছ ঠিকমত মাছ পাতাম না, সেই সাথে ডাকাতের চাপ বেশি থাকায় সুন্দরবনের মাছ করার কাজ বাদ দিয়ে ভাটায় যাওয়া শুরু করি।’ বললেন শুশান্ত নিজেই।
সুন্দরবনের নদীতে আগের মত মাছ মেলে না। আগে কাইন, পায়রা, দাতিনা, পারশে, টেংরা, বালে, গাংরা, টেপা, আমাদি, খয়রা, ভেটকি, পাঙ্গাস, কৈবল, সাত হাতে, গুলেসহ বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ী মাছ পাওয়া যেত। এগুলোর পরিমাণ ও প্রজাতি বেশি পাওয়া গেলেও এখন আর ঠিকমত পাওয়া যায় না। যার ফলে যেটা আয় হয় সেটা দিয়ে সংসারের করচ সংকুলান হয় না। তাছাড়া সুন্দরবনের জলদস্যুর উপদ্রব বেশি। ধরলে মোটা অংকের চাদা দিতে হয় অসহায় জেলেদের। পরিস্থিতির কারণে সুশান্ত মন্ডল টিকিয়ে রাখতে পারলেন না নিজের পূর্ব পুরুষের জেলে পেশা। পেশা বদলে হয়ে গেলেন শ্রমিক।