মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করতে চান ফুল বিক্রেতা জহুরুল
চাটমোহর থেকে ইকবাল কবীর রনজু
“বাবা আওয়াল মন্ডল কৃষি শ্রমিক ছিলেন। জমাজমি ছিল না আমাদের। অভাবের সংসার। আমরা পাঁচ ভাইবোন। মাসহ বাড়ির খানে আলা তখন ৭ জন। বড় পরিবার। পরের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করে বাবা যে টাকা পেতেন তা দিয়ে নুনে ভাতে চলতো আমাদের সংসার। আমাদেরকে পড়ানোর মতো সাধ্য তার ছিলো না। ছোটবেলায় বুঝিনি। এখন বুঝি। পড়ালেখা না জানলে জীবনের প্রতি পদে পদে ঠকতে হয়। তাই আমি নিজে মুর্খ হলেও যত কষ্টই হোক আমার তিন মেয়েকে পড়ালেখা করাবো। এ জন্যই তো যুদ্ধ করছি। জীবন যুদ্ধ। উপার্জনের আশায় ভোর হতে না হতেই প্লাস্টিক জাত ফুল খেলনা বিক্রির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। দিন কাটে রাস্তায় রাস্তায়। গ্রামে গ্রামে। নিজের স্ত্রী, মেয়েদের সাথে দেখা হয় দশ পনেরো দিন পর পর। মালামাল নিয়ে ছুটে চলি এ শহর থেকে ও শহরে। এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। যখন যেখানে যাই সেখানেই কয়েক দিনের জন্য অস্থায়ী ঘর ভাড়া করি। বিক্রি শেষ হলে বাড়ি চলে যাই। বাড়িতে দু’একদিন সময় কাটিয়ে ফের বেরিয়ে পড়ি নতুন জায়গায়।” পাবনার চাটমোহর-ছাইকোলা সড়কের দোলং গ্রামে পাকা সড়কের উপর দাড়িয়ে গত বুধবার কথাগুলো বলছিলেন প্লাস্টিকের বাহারী রঙের ফুল বিক্রেতা আত্মপ্রত্যয়ী যুবক জহুরুল ইসলাম (৩০)। বাড়ি নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার জামগ্রামে।
স্ত্রী মায়া খাতুন (২৩) এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ এ স্টুবক বলেন, “ মায়া প্লাস্টিকের শাপলা ফুল, জবা ফুল, গোলাপ ফুল, মানিক চান (চায়না) ফুল, চড়কিসহ বিভিন্ন রকম মনোলোভা ফুল ও খেলনা বানাতে পারে। আমি যখন বাইরে থাকি তখন মেয়েদের দেখাশুনা এবং বাড়ির অন্যান্য কাজ করার পাশাপাশি এ সব ফুল ও খেলনা তৈরি করে সে। জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে ও আমাকে সহায়তা করে আসছে। ও এগুলো বানায় আর আমি বিক্রি করি।” তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি শাপলা ফুল, জবা ফুল, গোলাপ ফুল, সূর্যমুখী ফুল, মানিক চান ফুল দশ টাকায় এবং চড়কি পাঁচ টাকায় বিক্রি করি। চাটমোহরের রেল বাজারে কয়েক দিনের জন্য একটি রুম ভাড়া নিয়েছি। এখানে কয়েকদিন বিক্রি করে চলে যাবো। প্রতিদিন অনেক পথ হাটতে হয় আমাকে”।
বাঁশের টুকরোর উপরিভাগে গমের ডাটা দিয়ে তৈরি বেদীর মাঝে নাইলন জাতীয় কাপড়, গুনা, প্লাস্টিক পাইপ ও বাঁশের শলাকা দিয়ে তৈরি ফুল ও খেলনাগুলো বিঁধিয়ে রাখেন তিনি। নওগাঁ এর পাইকাররা ঢাকার মোকাম থেকে ফুল তৈরির উপকরণ কিনে আনেন। নওগাঁয়ের চেয়ে শান্তাহারে এসব উপকরণের দাম কিছুটা কম বলে তিনি শান্তাহার থেকে ফুল ও খেলনা উপকরণ কিনেন বলে জানান। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি ফুলের কাপড় এক হাজার টাকা এবং প্লাস্টিক উপকরণগুলো তিনশ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা তার প্রধান ক্রেতা। গ্রাম গঞ্জের স্কুলগুলোর পাশে তিনি যখন কাঁধে ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হন তখন শিক্ষার্থীরা ভীড় জমায় তার চারপাশে। কেউ কিনে নেয়। আবার কেউবা দেখেই ফিরে যায়। অনেক জায়গায় বড়রা ও ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য তার নিকট থেকে ফুল কিনে থাকেন। প্রতিদিন আটশো থেকে বারোশা টাকা বিক্রি করতে পারেন। ছেলে মেয়েদের সান্নিধ্যে যখন থাকেন তখন নিজের বাচ্চাদের কথা খুব মনে পরে। বড় মেয়ে জুঁই জাম গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। অন্য দু’টি মেয়ে ছোট। ওরা এখনো স্কুলে যায় না বলে জানান তিনি।
জহুরুল বলেন, “বারো শতক বসতবাড়ি আছে। বাবার নিকট থেকে কোন আবাদী জমি পাইনি। নিজে জমি কিনতেও পারিনি। কষ্ট করে সংসার চালানোর পাশাপাশি এক লাখ ২০ হাজার টাকায় অন্যের তিন বিঘা জমি কট (বন্ধক) রেখেছি। চাষাবাদ করছি জমিগুলো। পাঁচ জনের সংসারের পেটের ভাত হয়ে যায় জমির ধানে।” জমির মালিক যখন জমি ফিরিয়ে নিবেন তখন পুরো টাকাই ফেরত দিবেন। আপনার ভবিষ্যতের ইচ্ছা কি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করাই আমার প্রধান ইচ্ছা”। পাশাপাশি একটি পাকা বাড়ি করার ও ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি।