পেশা আমার কাছে দেবতার মতো- শ্যামল কামার
মানিকগঞ্জ থেকে সুবীর কুমার সরকার
লোহা পুঁড়িয়ে দা, কাঁচি, কুড়াল, কোদাল, বটি, শাবল, সরতা, ট্রাক্টরের খিল, নাংল্যার খিল, আকড়া প্রভৃতি বানানো নিত্য দিনের কাজ শ্যামল কামারের। ঘিওর উপজেলার নালী গ্রামে শ্যামল কামারের বসবাস। মা-বাবা, ছেলে, ভাই-বোনদের নিয়ে যৌথ পরিবারে বসবাস।
বাড়ির পাশেই বাজার। সেখানেই ম্যাইট্যা টিনের দু’চালা একটি দোকান ঘর। সকাল থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত এবং বিকাল ৪ টা থেকে রাত ৭ টা পর্যন্ত হাতুড়ি দিয়ে লোহা পিটিয়ে তৈরি করছে কৃষি কাজের ও বাড়িতে ব্যবহারের বিভিন্ন উপকরণ। শ্যামল কামার তার পূর্ব পুরুষের কাছে হাতে খড়ি নেন এই কাজের। তার পূর্ব পুরুষরা কেউ আজ আর জীবিত নেই।
তিনি এই কামারের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। পূর্ব পুরুষের কাজ ধরে রাখতে তার ছোট ভাই বিমল কামার কে নিজে হাতে খড়ি দিয়ে কাজে লাগান। এখন দুই ভাই এক সাথে কাজ করেন। শ্যামল কামারের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই কামারের কাজ এখন অনেকেই পরিশ্রমের ও নিচু মানের কাজ মনে করে। তাই তাদের সম্প্রদায়ের অনেকে এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি কাজটা ছাড়তে পারেননি ছোট বেলা থেকে এই কাজটা তিনি শিখেছেন। তিনি নিজে কোন কাজকে ছোট মনে করেন না। তিনি চিন্তা করেন সৎ থেকে উপার্জন করা যায়- এমন কোন কাজই ছোট নয়। তাই তো তিনি সম্মানের সাথে দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ কাজটা করে চলছে। এলাকার অধিকাংশ মানুষ শ্যামল কামারকে চেনে তার কাজের মধ্যে দিয়ে। শ্যামল কামারের বানানো বটি অনেক বড় বড় চাকুরিজীবীও ব্যবসায়ীদের বাসায় গেছে।
শ্যামল কামারে জিনিস তৈরি করতে একট বেদি তৈরি করতে হয়। কয়লা লাগে, হাতুড়ি, চিমটি সহ কিছু উপকরণ প্রয়োজন হয়। একটি ধারালো কাঁচি ধার কাটার দর ৬০-৭০ টাকা, দা-বটিতে লবণ পানি দিতে নেওয়া হয় ৭০-৮০ টাকা, নিরানি কাচি ধার দিতে ৪০-৫০ টাকা, লোহার পাত দিয়ে দা-বটি তৈরি করতে ১০০০ টাকা। এই জিনিসগুলো কেজি হিসেবে তৈরি করেন। শ্যামল কামার সবেচেয়ে বেশি তৈরি করেন কোদাল। আর সেটা তিনি স্থানীয় বরংগাইল হাটে পাইকার ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। সমগ্র নালী ইউনিয়নে ২-৩ জন আছেন যারা কামারের কাজ করেন। তার মধ্যে শ্যামল কামার এর কাজ বেশি। সারাদিন পরিশ্রম করে তার চোখে মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে। প্রতিদিন তিনি ৭০০-৮০০ টাকা উর্পাজন করেন।
প্রায়শই এমন অনেকে দূর হতে নানা লোক আসে দা, বটি, কাচিঁ বানানোর জন্য; যাদেরকে তিনি অনেক সময় চিনতেই পারেন না। কিন্তু তারা ঠিকই চেনেন এবং তার কাছ থেকেই বানোনোর জন্যই এসেছেন। সকালের দিকে তার দোকানে থাকলে দেখা যায়, প্রবীণ লোক নানা জিনিস বানাতে নিয়ে আসে। প্রবীণদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শ্যামলের কাছে আসলে কাজ করাতে অনেক দেরি হয়। আর যেহেতু তাদের তেমন কোন কাজ নেই তাই তারা এখানে সময়ও কাটান। শ্যামল কামার যে পেশাটা ধরে রেখে সন্মানের সাথে কাজ করছেন তা দেখতে তাদের ভালো লাগে বলে জানান। লোহার জিনিসের জন্য এক বিশ্বস্ত এবং ভরসার নাম শ্যামল দা। এলাকার সবার কাছে এ নামেই বেশি পরিচিত। এই প্রসঙ্গে শ্যালম কামার বলেন, “বর্তমানে মানুষেরা লোহার জিনিস অনেক তৈরি করে। আমার হাতে সবসময় কোন না কোন কাজ থাকে। আমরা দুই ভাই কাজ করে সারতে পারি না। অনেক সময় কাজ করে দিতে না পারলে মানুষের মন খারাপ হয়। তখন আমার নিজের কাছেও খারাপ লাগে। মানুষতো ভালো কাজটা পেতেই আমার কাছে আসে।
শ্যামল কামারের কাছে তার পেশা দেবতার মতো। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষে বিশ্বকর্মা পূজা করেন। সেদিন তিনি কোন কাজ করেন না। কাজ করলে কোন পেশাকেই ছোট মনে হয় না। কামার, কুমার, জেলে, ধোপা, নাপিত সকল পেশা আমাদের বাংলার সংস্কৃতি। সকল পেশাকে তাই টিকিয়ে রাখতে হবে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই।