জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বৈচিত্র্যময় ফসলের আবাদ
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর পদ্মা তীরবর্তী নিচু এলাকা পলিযুক্ত মাটিতে বৈচিত্র্যময় ফসল আবাদে সহায়ক। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পলি পড়ে মাঠে-ঘাটে প্রবাহিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে রোধের খড় তাপ, অসময়ে বৃষ্টি কিংবা প্রয়োজনের সময়ে বৃষ্টি না হওয়া এবং পোকার আক্রমণের কারণে আবাদের খরচ রেশি হচ্ছে দিনকে দিন। অন্যদিকে উৎপাদনও ক্রমশ কমে আসছে। বৃষ্টিহীনতার ফলে জমিতে মাটির জো না থাকায় শস্য বপনে সময় হারিয়ে কৃষক বসে থাকেন। জমিতে বীজ বপন করতে পারছে না। আবার দেখা যায়, জমিতে বীজ বপন করলেও খরার কারণে, মাটি আদ্রতা বা পানির অংশ না থাকায় ফসল ভালো হচ্ছে না। খরার কারণে কৃষক ফলন পাচ্ছেন না। আবাহাওয়া পরিবর্তনের ফলে কৃষকের অভিজ্ঞতা থাকা স্বত্ত্বেও চাষাবাদে ভালো ফল পাচ্ছে না। বর্তমানে পরিবেশের বিরূপ প্রভাবে কখন কি হবে, তা বুঝতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। কৃষকগণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ফসল চাষাবাদ করতে পারছেন না। প্রকৃতির বিরূপ পরিশের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষককের নিকট থেকে ফসল বৈচিত্র্যে। তবে বারসিক স্থায়িত্বশীল চর্চা ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বীজবৈচিত্র্য আবাদে বীজ বিনিময় গুরুত্ব দিয়ে বীজ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বৃদ্ধিতে কৃষকদের আবাদে উৎসাহিত করে আসছে।
এই প্রসঙ্গে বাহিরচরের কৃষক শহীদ বিশ^াস (৪৫) বলেন, ‘প্রকৃতির বিরুপ ও প্রতিকুল অবস্থার কথা চিন্তা করেই মাঠে মিশ্র ফসল আবাদ করছি। একই জমিতে তিন থেকে চারটি (যেমন-পেঁয়াজ, বাঙ্গি, আইলের সাথে রাঁধুনি আবার তিল, বাঙ্গি, আইলে সবজি) ফসল আবাদ করি। একের পর এক ফসল উঠে। ফলে বীজ সংরক্ষণ ও ভালো ফসল উৎপাদন হয়। কৃষক পর্যায়ে বীজবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বিনিময় করতে পারি। আমন মৌসুমে পানির সাথে তাল মিলিয়ে ধান গাছ বাড়তে পারে এমন জাতের হিজল দিঘা, দিঘা, ভাউয় ঝাক, তিল ভাজাল, মধুশাইল, ভাউয়াইলা, দুধ ভাইয়াইল্যা ধান করছি। কিন্তু হঠাৎ অতিরিক্ত বর্ষা বা বন্যার পানির ফলে কৃষকদের আবাদ নষ্ট হয়। কৃষক পর্যায়ে অল্প পরিমাণে বেঁচে থাকা বীজবৈচিত্র্য থেকে বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে ফসলবৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। বর্তমানে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে মৌসুমে ভিন্ন ধরনের মসলা, তেল ফসল, শাক সবজি ও ধান আবাদ করছি।’ বারসিক প্রায় হরিয়ে যাওয়া তিশি, কাউন বীজ দিয়ে ও জৈব উপায়ে চাষাবদে প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা বিনিময় ও আলোচনা করে কৃষকের পাশে থেকে উদ্যোগ সহযোগিতা করে সহযোগিতা করে।
অন্যদিকে হরিহরদিয়ার সানজিদা বেগম (৪০) বলেন, ‘চরাঞ্চালের উঁচু জায়গায় আউশ মৌসুমে মাঠে আবাদ করেন পাংঙ্গি ও কালো আউশ ধান। কৃষক বৈশাখে ধান বপন করেন, বর্ষার পানি আসার আগে আষাঢ় মাসে ধান কর্তন করে ঘরে তুলেন। প্রাকৃতিক পরিবেশে আউশ ধান চাষ হয়। চরের কৃষক-কৃষাণীগণ খাদ্য উৎপাদন আর বৈচিত্র্যতাকে টিকিয়ে রেখে মাঠে চাষ করেন হরেক রকমের ধান, শাক-সবজি, তেল, মসলা, ডাল জাতীয় ফসল। কৃষকগণ চরে বন্যার পরবর্তীতে পলি মাটিতে ভাদ্র মাসে ভিজা অবস্থায় মাস কলই, খেসারি ডাল বীজ বপন করেন। পৌষ মাসের শেষ দিকে মাসকলই, খেসারি কালাই ফাল্গুন মাসে ফসল সংগ্রহ করি। শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বাড়িতে ও মাঠে শাক সবজি চাষ করি। বর্ষায় উঁচু জায়গায় শাক সবজি চাষ করি ও বীজ সংরক্ষণ করি।’
পাটগ্রামচরের কৃষাণি হাজেরা বেগম (৫৫) বলেন, ‘কৃষিই চরের মানুষের জীবন। কৃষি ছাড়া আমরা অন্য কিছু ভাবতেই পারি না। বাড়ির সব কিছুই কৃষিকে নিয়ে। চরের মানুষের প্রাণি সম্পদ গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি-কবুতর, ঘোরা, মহিষ পালনের মাধ্যমে জীবিকায়নে সহায়ক হয়। আমরা নারী-পুরুষ সকলে মিলে আবাদ বসতের কথা ভাবি। চরের মাটিতে ধান, গম, পাইরা, কাউন, তিল, তিশি, ডাল, শাক-সবজি, পাট, তেল জাতিয় সকল ফসল ফলে। সবচেয়ে কম খরচে চাষাবাদের একমাত্র সহায়ক হলো বন্যার ফলে পলি মাটি ও গোবর সার। পলি মাটির ফলে আমরা খুব সহজে সার বিষ ছাড়া সকল ফসল পাই। বীজ রেখে আবাদ করতে পারি। যদিও প্রকৃতির বিরূপ পরিবেশে কৃষকে আবাদে সফল হতে হয়। কৃষি বৈচিত্র্য ও আবাদ কৃষকেরই সফলতার ফল। কৃষি বৈচিত্র্যতা রক্ষায় উপযোগি জায়গা হলো চর।’
হরিহরদিয়ার কৃষক নান্নু পরামানিক (৫৫) বলেন, ‘হরিরামপুরের পলি মাটিতে শীতকালীন ফসল সহজে চাষ করা যায়। কিন্তু বর্ষার সময় আবাদের জন্য কৃষকগণ চিন্তা করে আবাদ করেন। বর্ষার আগে ফসল ঘরে তুলতে পরাংঙ্গি আউশ ও কালামানিক ধান চাষ করি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যার পানি মোকাবেলায় নিচু জমিতে হিজল দিঘা, ডেপর, দিঘা জাতের ধান চাষে সফল হয়। বন্যার পরবর্তীতে জমিতে মিশ্র ফসল গম, পাইরা সাথে আইলে ধনিয়া, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, মুসুর ডাল, মরিচ চাষ করে থাকি। মিশ্র ফসল চাষাবাদে পোকার আক্রমণ কম হয় ও জমির মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় ও কৃষিবৈচিত্র্যতা রক্ষা হয়।’
হরিরামপুরের উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আব্দল ছালাম মোল্লা বলেন, ‘হরিরামপুর নিচু এলাকা হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার মধ্য দিয়েই মাঠে ফসল বৈচিত্র্যে ভরপুর হয়। কৃষক-কৃষাণীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতায় দুর্যোগ মোকাবেলার ফলেই শস্যে ভরে উঠে কৃষকের ঘর, দেশ পরিপূর্ণ হয় খাদ্যশস্যে। কৃষিতে কৃষকের দক্ষতা ও পরিবেশসম্মত চাষাবাদ বৈচিত্র্যতা সংরক্ষণে সহায়ক হয়। পরিবেশসম্মত উদ্যোগ চর্চার মধ্য কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও খাপ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে নিজেরা কৃষি চর্চা করে অন্যান্য কৃষকদেরকে তথ্য প্রদান করে উদ্যোগ গ্রহন করেন। ফলে পরিবেশ স¤œত উদ্যোগ চর্চার মাধ্যমে কৃষি জাতবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বিনিময়ের মাধ্যমে চাষাবাদ উদ্যোগ বৃদ্ধি পায়।’
কৃষকগণ রকমারি ফসল আবাদেই দুর্যোগ মোকাবেলা কওে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। মাটির ধরন অনুযায়ি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে বৈচিত্র্যময় ফসল আবাদ করেন। প্রকৃতির মাটি, আলো, বাতাস, পানির সমন্বয়ে ফসল উৎপাদনে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। কৃষকদের জমিতে নিজেদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা কাজে লাগিয়ে খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করে আসছেন।