মাদকমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে সবুজে সন্ধানে যুব সংগঠনের উদ্যোগ
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী:
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলছে বিশ্ব। অন্যদিকে উন্নয়নের সাথে তাল দিয়ে টিকতে না পেরে উন্নয়নের চাপে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামীণ জাতিগত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। সংস্কৃতি ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়ায় পারস্পারিক নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রেও ভাটা পড়েছে। আধুনিকায়নের ছোয়ায় গতিশীল কর্মজীবনে বিলীন হচ্ছে মানুষের সত্যিকারের নৈতিকতার। স্থায়ীভাবে সমাজে ঠাই করে নিয়েছে অনৈতিকতা, বাল্যবিবাহ, যৌতুক, মাদক, অশ্লীলতা ও ধর্ষণের মত মারাত্বক সামাজিক ব্যাধি। অর্থনীতি হয়ে পড়েছে বাজার নির্ভর। পারস্পারিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রগুলো বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রগুলো শক্তিশালীকরণে গ্রামে স্ব-উদ্যোগ বেশ কিছু জনসংগঠন গড়ে উঠেছে। এসব সংগঠন নিজস্ব প্রচেষ্টায় এলাকার উন্নয়নে ছোট ছোট উদ্যোগ গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করে আসছে।
নেত্রকোণা সদর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের একটি কৃষি নির্ভর গ্রামের নাম কাছিমপুর। গ্রামের যোগাযোগ অনুন্নত হওয়ায় বর্তমানে বাজার অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলা গ্রামবাসীদের পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সরকারী-বেসরকারী সুযোগ সুবিধার খুব একটা কাছিমপুর গ্রামে পৌছেনা। ফলে গ্রামবাসীরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার সম্মূখীন হয় প্রতিনিয়ত। কাছিমপুর গ্রামবাসী পার্শ্ববর্তী গ্রাম সাজিউড়ার এক যুব সংগঠনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের সাথে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকে। সাজিউড়া যুব সংগঠনের সাথে তারা নিজ এলাকার পরিবেশ, গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে। সাজিউড়া যুব সংগঠনকে দেখে কাছিমপুর যুবদের মধ্যে অনুরূপ সংগঠন গড়ে তোলার আগ্রহ থেকে গ্রামের ৩০ জন যুব মিলে গড়ে তুলে ‘সবুজে সন্ধান যুব সংগঠন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। যুব সংগঠনটি এলাকার উন্নয়নে ও এলাকার পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এলাকার কৃষক, সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি এবং এলাকার পরিবেশগত উন্নয়নে সহযোগিতা দিয়ে সমাজের অন্যদেরও উদ্যোগ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে। সাংগঠনিক উদ্যোগে এলাকায় বৈচিত্র্যময় ফলের চারা রোপন করে গ্রামের শিশুসহ সকলের পুষ্টির চাহিদা দূরীকরণের চেষ্টা করছে। সংগঠনটি স্থানীয় জাতের ফলদ ও ঔষধী গাছের প্রতি গ্রামবাসীদের আগ্রহ সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামের পরিবেশ রক্ষা, পুষ্টির চাহিদা পূরণে কাছিমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৬০টি ফলের ও ঔষধী গাছের চারা (৫ ফলের জাত, ৩টি ঔষধী জাত) এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দূর্যোগ (বজ্রপাত) মোকাবেলা স্কুলের পাশের রাস্তার ধারে ২০০টি তাল বীজ রোপন করেছে।
যুব সমাজই আগামী দিনের ভবিষ্যত। এ দেশ, দেশের শিক্ষা ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করে সমৃদ্ধশালী করে তুলবে আমাদের যুব প্রজন্ম। গ্রামের বেশকিছু যুবকদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা চোখে পড়ে যুব সংগঠনের সদস্যদের। আর এ বিষয়টি ভাবায় সংগঠনের সকল সদস্যদের। তারা এ সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, সকল শ্রেণী ও বয়সের লোকদের যুক্ত করে পারস্পারিক সহযোগিতা, গ্রামীণ সাংস্কৃতিক চর্চা এবং স্থানীয় খেলাধূলার চর্চাই পারে সুস্থ্য, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের মাধ্যমে যুব সমাজকে সুরক্ষা করতে। বিভিন্ন ধরণের আধুনিক খেলাধুলার জন্য প্রয়োজন হয় উপকরণের ও প্রয়োজনীয় অর্থের। যেমন- ফুটবলের জন্য বল, ক্রিকেট খেলার জন্য ক্রিকেট বল, বেট, স্ট্যম্প, ক্যাপ, কেরামবোর্ড, লুডু, দাবা সেট ইত্যাদি। কিন্তু স্থানীয় গ্রামীণ খেলাধুলায় জন্য তেমন কোন উপকরণ বা অর্থের প্রয়োজন হয়না, প্রয়োজন হয় শুধু ইচ্ছা ও আগ্রহের। তাই সংগঠনটি গ্রামের যুবদের জন্য আয়োজন করে বিভিন্ন ধরণের গ্রামীণ খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক র্চচার। প্রতিদিন বিকাল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এলাকার মাদকাসক্ত যুবদের নিয়ে সচেতনতামূলক আলোচনা ও গ্রামীণ খেলাধূলার আয়োজন করে সংগঠনটি। যুবদের এই উদ্যোগ তাই অবারও মনে করিয়ে দিল যে একটি সুন্দর সমাজ গঠনে যুব সমাজের গুরুত্ব অপরিসীম। এতে যুব সমাজের প্রতি পরিবার ও সমাজের অন্যদের ইতিবাচক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে।
কাছিমপুর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি রহিছ মিয়া বলেন,“ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদক সেবন থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে বই পড়ার প্রতি তাদেরকে আগ্রহী করে তুলতে হবে এবং নিয়মিত গ্রামীণ খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই ধীরে ধীরে গ্রামের যুবকরা সমাজ বিরোধী কাজ ও মাদক থেকে নিরাপদ থাকবে। নৈতিকতার শিক্ষায় তারা নিজেদের সর্বদা উজ্জ্বীবিত রাখতে সক্ষম হবে। তিনি গ্রামের ‘সবুজের সন্ধানে যুব সংগঠন’র কার্যক্রমকে স্বাগত জানান।