উপকূলীয় প্রান্তিক মানুষের মৌসুমী পেশা কুচে মাছ ধরা
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা ও পেশার পরিবর্তন হচ্ছে। বেঁচে থাকার তাগিদেই তাই মানুষকে নতুন পেশা বেছে নিতে নিচ্ছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর এলাকার সব ধরনের কৃষক-কৃষাণী লবণ পানির আগ্রাসন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের আদিপেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিবর্তিত নতুন পেশার মধ্যে কুচে মাছ সংগ্রহ অন্যতম।
শ্যামননগর এলাকার সব পেশার মানুষেরা এ কুচে মাছ ধরার সাথে সম্পৃক্ত। লবণ পানির চিংড়ী ঘেরে কুচে মাছ পাওয়া যায়। চিংড়ী ঘের যখন শুকায় তখন এই মাছগুলো পাওয়া যায়। সাপের মত দেখতে কুচে মাছ সাদাটে ও লাল এ দু’ধরনের পাওয়া যায়। প্রতিটা কুচে মাছের উচ্চতা দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা হয় এবং ওজন ১০০ গ্রাম থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। বছরের কার্তিক থেকে মাঘ এই চার মাস এলাকার লবণ পানির চিংড়ী ঘের শুকায় (ঘেরের সম্পূর্ণ পানি সেচ দিয়ে ফেলে দেয়)। তখন এই নরম কাদা মাটির মধ্যে থেকে মাছগুলো ধরে। কুচে মাছ নরম কাদা মাটির অনেক গভীরে ছোট চিকন চালায় (বাসা) অবস্থান করেন। আগে এই কুচে মাছ ধরত জেলেরা, এখন জেলে, আদিবাসী মুন্ডা, কাহার, সরদার ও সনাতন সম্প্রদায়সহ নানা পেশার নারী পুরুষেরা এ কুচে মাছ ধরেন। খুব ভোরে সকালের খাবার শেষ করে একটি বড় পাত্র খারা/হাড়ি/বালতি নিয়ে তারা মাছ ধরার জন্য দুর দুরান্তের ঘেরে প্রবেশ করেন। বিকাল পর্যন্ত চলে তাদের কুচে মাছ ধরা। এই মাছ তারা নিয়ে স্থানীয় বাজারে কেজি দরে বিক্রি করেন। ভালো লাভও হয়। এই প্রসঙ্গে মাছ সংগ্রহকারী মধাব হাউলী বলেন, “মানুষ বছরের এই তিন/চার মাস জন মজুরি খাটবে কেন, একদিন মাছ ধরলে সাত/আট শ টাকা হবে, তবে প্রথম দুই মাস কুচে মাছ পাওয়া যায়, দামও বেশি।” বছরের প্রথমদিকে অর্থাৎ কার্তিক/অগ্রহায়ণ মাসে এলাকায় কুচে মাছের দাম বেশি থাকে। এসময় কলবাড়ী, মুন্সিগঞ্জ, হরিনগর, নওয়াবেঁকী, নীলডুমুর প্রভৃতি বাজারে প্রতি কেজি মাছের দাম থাকে ৮০/৭০ টাকা। মৌসুমের শেষ দিকে দাম পাওয়া যায় কেজি প্রতি ৩০/৩৫ টাকা ।
সংগৃহীত মাছগুলোর জন্য স্থানীয় বাজারে ঘরে কেনা বেচা চলে। সংগ্রহকারীরা নগদ দামে ঘরে বিক্রি করেন। এ মাছগুলো মূলত সুন্দরবনের কাঁকড়া ধরার জন্য ব্যবহৃত হয়। যারা কাঁকড়া সংগ্রহকারী তারা বাজারের এসব ঘর থেকে মাছ ক্রয় করেন। ক্রয়কৃত মাছ ড্রামে ভরে লবণ দিয়ে নিয়ে যান কাঁকড়ার চার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। সংগ্রহকারীর অনেকেই বেশি দামের আশায় তারা নিজের মাছগুলোতে লবণ দিয়ে রোদে শুকিয়ে রাখেন। পরবর্তীতে এই শুকনা মাছ কেজি প্রতি ১৬০/১৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
সংগ্রহকারীরা বছরের এই তিন/চার মাস সংসারের খাবার মাছের অভাব হয় না। কেননা বড় আকারে মাছগুলো তারা নিজেরা সংসারের খাবারের মাছ হিসেবে ব্যবহার করেন। বাজারের যারা ঘর মালিক তারা নিজেরা সংগ্রহকারীর কাছ থেকে এই মাছ কিনে নেন। তারপর এ মাছ গুলো কাকড়া সংগ্রহ কারীদের কাছে বিক্রি করেন। বিক্রয় শেষে যেগুলো বেশি থাকে সেগুলো গাড়ীযোগে খুলনাতে ও ঢাকাতে চালান করা হয়। সেখান থেকে এ মাছগুলো বাস্কেটে ভরে প্রক্রিয়াজাত করে চীন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করা হয় বলে জানা যায়। কুচে ব্যবসায়ীরা বছরের অন্য সময়গুলোর জন্য এ মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন। দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর স্বল্প সময়ের মৌসুমী আয়ের এ উৎস কুচে মাছ সংগ্রহ। আর এ কুচে মাছ পরিবার, সমাজ তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।