বৈচিত্র্যময় ফসলের ভাণ্ডার মাফুজা আক্তারের শতবাড়ি
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
গ্রামীণ পরিবারের নারী সদস্যরা কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে সারাদিন যুক্ত থাকেন। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে একই চিত্র লক্ষ্য করা যায়। তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া আমাদের কৃষিকাজ অসম্পূর্ণ।
তেমনই একজন নারী লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের মাফুজা আক্তার, স্বামী কৃষিকাজ করেন। তাই বিয়ের পর থেকেই তিনি স্বামীর সাথে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন। গ্রামের একটি সাধারণ গেরস্ত বাড়ির চিত্র তাঁর বাড়িতে ফুটে উঠে। ঘরের একপাশে বারোমাসী বেগুন, অন্যপাশে মরিচ গাছ। হাত বাড়ালেই প্রয়োজনীয় জিনিসটি তিনি সংগ্রহ করতে পারেন। উঠানের দক্ষিণ কোণে আছে তুলসী গাছ, পরিবারের সদস্যদের ঠান্ডাজনিত সমস্যায় তিনি এই পাতার রস ব্যবহার করেন।
আগে মাফুজা আক্তারের স্বামীর বাড়িটি এমন ছিলনা। তিনি যখন এখানে বৌ হয়ে আসেন তখন থেকেই নিজের পছন্দমতো বাড়িটি সাজিয়েছেন। স্বামী যেহেতু একজন কৃষক, তাই এই কাজে তিনি মাফুজাকে সহযোগিতা করেছেন। বসতভিটা ও এর আশেপাশের সব্জী চাষের সকল কাজ ও সিদ্ধান্ত মাফুজাই গ্রহণ করেন। এছাড়া বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজটি তিনিই করেন। সব্জী চাষের জন্য তিনি গরুর গোবর ব্যবহার করেন।
তাঁদের চাষযোগ্য নিজস্ব জমি মাত্র ৮০ শতাংশ। এই জমিতে ধান চাষ করেন। এছাড়া ২০ শতাংশ জমি আছে, যেটাতে সারাবছর তিনি বিভিন্ন ধরণের সব্জী চাষ করেন। এসব সব্জীর মধ্যে রয়েছে বেগুন, আলু, শিম, দেশিলাউ, মিষ্টিকুমড়া, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, করলা, পুঁইশাক, চালকুমড়া, ডাটা, ঢেঁড়স, টমেটো, শশা ইত্যাদি। এছাড়া বসতভিটার পাশে আছে বারোমাসী বেগুন, মরিচ ও স্বর্ণআলু।
মসলার মধ্যে রয়েছে পিঁয়াজ, রসুন, আদা, লাফা মরিচ, হলুদ, ধনিয়া ইত্যাদি। গ্রীষ্মকালীন মরিচ বিক্রি করেছেন প্রায় ৫ হাজার টাকা। সারাবছরের নিজের পরিবারের খাবার বাবদ মরিচ সংরক্ষণ করে রেখে ২০ কেজি’র মতো মরিচ শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রেখেছেন, যেগুলো তিনি পরবর্তী সময়ে বীজ হিসেবে বিক্রি করবেন। তাঁর বাড়িতে উৎপাদিত অন্যান্য মসলা তিনি পরিবারের খাবার হিসেবে ব্যবহার করেন।
১০ শতাংশ জায়গায় পুকুর আছে। পুকুরে রুই, মৃগেল, কাতল, তেলাপিয়া, কার্ফু মাছ ছাড়াও কৈ, পুঁটি, শিং, লাটি, টেংরা, মলা, চিংড়ি, চান্দা, চিকরা, গুতুম ইত্যাদি আছে। বাড়ির একপাশে আছে ছোট্ট একটি ডোবা, এখানেও বিভিন্ন ধরণের স্থানীয় মাছ পাওয়া যায়। তাই তাঁদের পরিবারের জন্য বাজার থেকে মাছ কিনতে হয় না। আবার অনেক সময় বিক্রিও করতে পারেন।
তাঁর বৈচিত্র্যময় সব্জী চাষ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, আমরার ফসকৃষি (সব্জী) মাড়াইয়াই (চাষ করে) খাওন লাগবো। আর বাজার থেইক্যা কিনলে মুরাদ (আয়) দেয়না। স্বাদও লাগেনা। নিজের বাড়িত্ থাকলে যে কোনো সময়, পছন্দ মতন তরকারি রাইন্ধা খাওন যায়। আবার বাজার থেইক্যা আনলে মাপ (ওজন) মতন আনে, তাড়াতাড়ি শেষ অইয়া যায়। বাড়ির সব্জী তো আ-মাপা (মাপ বা ওজন ছাড়া)। ইচ্ছা মতন তুইল্যা রান্দা খাওয়া করন যায়।’
তাঁর বাড়িতে প্রাণিসম্পদের মধ্যে মুরগি ৮টি, হাঁস ৩টি ও ৩টি গরু আছে। মাংস, ডিম ও দুধ নিজের বাড়ি থেকেই পেয়ে থাকেন। ফলজ গাছের মধ্যে আম ৫টি, কাঁঠাল ২টি, পেয়ারা ৬টি, নারিকেল ৪টি, সুপারি ৪০টি, অড়বড়ই একটি, বড়ই একটি, জাম্বুরা ৪টি, বুবি (লটকন) ২টি গাছ আছে। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে আমড়া ও বারোমাসী লেবুর চারা রোপণ করেছেন। বাড়িতে থাকা এসব ফল সারাবছর পরিবারের সদস্যদের চাহিদা পূরণ করে। মাঝে মাঝে কিছু ফল বাজারে বিক্রি করে বাড়তি টাকা দিয়ে সংসারের অন্যান্য চাহিদা পূরণ করেন। এবছর তিনি প্রায় ৩,০০০ (তিনহাজার) টাকার স্থানীয় জাতের কলা (ডিঙ্গাকলা) বিক্রি করেছেন।
বাড়ির পাশের পতিত জায়গা, সব্জীর ক্ষেত থেকে বিভিন্ন অচাষকৃত উদ্ভিদ সংগ্রহ করে খাবার হিসেবে ব্যবহার করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কচুশাক, কচুর নালি, লতি, হেলেঞ্চা, বউত্তা, খ্ইুরা, থানকুনি, কলমীশাক, সুরমীকচু, এংচি (সোনাবন) ইত্যাদি। মাফুজা আক্তার নিজে সব্জী চাষের পাশাপাশি গ্রামের অন্যদেরও উৎসাহি করেন। এর জন্য তিনি বিভিন্ন বীজ ও চারা দিয়ে সহযোগিতা করেন। প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনের মাঝে বিভিন্ন ফল ও সব্জী বিতরণ করেন।
পরিবারের সকলের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে তাঁর বাড়িটিই যথেষ্ট। এ জন্য তাঁকে বাজার বা অন্যদের উপর নির্ভর করতে হয় না। নিজের চাহিদা মতো সব্জী চাষ করে একদিকে যেমন পরিবারের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখছেন, অন্যদিকে তেমনি পরিবেশসম্মত কৃষি কাজ করে পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখছেন।