বর্ষাকালেও নেই বৃষ্টি: জলবায়ুর খামখেয়ালিপনার প্রভাব কৃষকের ঘরে
রাজশাহী থেকে, অমিত সরকার
ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ পার হলেও দেখা নেই কাক্ষিত বৃষ্টির। এখনো যেনো সেই চৈত্র মাসের মতন খরা। কাঠফাঁটা তপ্ত রোদ ও ভ্যাবসা গরমে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে উঠছে। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মানুষসহ প্রাণীকূল। সেচ দিয়ে লাগানো আমন মৌসুমের ধান বাঁচাতে মহা দুশ্চিন্তায় পড়েছে কৃষক। অষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কাঙ্কিত বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষক সময় মতন জমিতে রোপা আমন রোপণ করতে পারছেন না। সেচ দিয়ে দেরিতে রোপণ করলেও বৃষ্টির অভাবে রোদে পুরে বিবর্ণ হয়েছে রোপা আমন ধানের চারাগুলো। ফেটে চৌচির হচ্ছে কৃষকের কষ্টে লাগানো আমনের ধানের জমি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের বরেন্দা গ্রামের কৃষক আনিচুর রহমান (৪২) জানান, সাধারণ সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত তাপদাহ হচ্ছে এবার। রোদের তাপে ঘর থেকে বের হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আষার-শ্রাবণ মাস পার হয়ে গেলেও বৃষ্টির দেখা নেই। ডিপেও পানি উঠেনা আগের মতন। বৃষ্টির অপেক্ষায় থেকে থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ধান লাগাতে পারিনাই। কোনমতে ডিপ থেকে সেচ নিয়ে জমি তৈরি করে ১৫ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছি। ডিপেও পানি উঠছে না এক বিঘা জমি ভিজাতে ৭/৮ ঘণ্টা পানি লাগছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এনজিও থেকে ঋণ করেছি কিভাবে শোধ করবো। টেনশনে রাতে ঘুমাতে পারিনা। কৃষক পরিবারের ছেলে কৃষি কাজ করেই পেট চালাই এই বছর আবহাওয়া আমাদের মারলো। পুকুর, খাড়ি-নালাগুলোয় পানি থাকার কথা থাকলেও তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। বৃষ্টি নেই এ অবস্থায় জমির ধান নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মৌসুমের আবাদ এখন অনিশ্চিত।’
এদিকে নাচোল উপজেলার কসবা ইউনিয়নের পাইকোড়া গ্রামের কৃষক মাসুদ রানা (৪৭) ব্রি ৭১ জাতের বীজতলা তৈরি করেছিলেন আমন মৌসুমের জন্য অতিক্ষরায় তার বীজতলা সম্পূর্ণ চারা মরে নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে বাজার থেকে ব্রি ৫১ ধানের চারা সংগ্রহ করে দের বিঘা জমিতে রোপণ করতে পারেন।’ একই গ্রামের কৃষক বেলাল (৪৬) তার ২ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করে ইতিমধ্যে ৩ হাজার টাকা সেচ বাবদ খরচ করেছেন আরো ২ হাজার টাকার সেচ লাগবে বলে জানান। খরিবোনা গ্রামের আরেক কৃষক হাফিজুল (৩৭) দুই বিঘা জমিতে শসা লাগিয়ে খরার কারণে অল্প দিনেই গাছ মারা যায়। ফলে অশা অনুযায়ী ফলন হয় নাই।
খড়িবোনা গ্রামে কৃষক গবেষক রঞ্জু আকন্দ ২০১৪ সাল থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের খড়িবোনা গ্রামে কৃষি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণামূলক কাজের সাথে যুক্ত আছেন । তিনি বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকে এলাকার প্রায় ২২টি গ্রামের কৃষকদের সাথে কাজের মাধ্যেমে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জেনেছি এ বছরের মতন বৃষ্টিবিহীন বর্ষাকাল এর আগে দেখে নাই কেউ।’
রাজশাহীর তানোর উপজেলার লালপুর গ্রামের কৃষক মো: খোদাবক্স (৫৭) বলেন, ‘অনেক কষ্টে ডিপ থেকে পানি সেচে ৯ বিঘা জমিতে ধানের চারা রোপণ করেছি। কিন্তু ১৫ দিনের মাথায় রোপণ করা ধান গাছগুলো পুড়ে গেছে। বৃষ্টি না হলে এবার আর ধান হবে না। শুধু একজন-দুজন নয়, প্রায় সবার ক্ষেতেই একই অবস্থা। এ বছর পানির অভাবে অনেক কৃষক বীজতলা তৈরি করতে পারেননি বলেও তিনি জানান।
শুধু লালপুর গ্রামে নয় তানোরের তালন্দ ও গোকুল মথুরা গ্রামে গিয়েও কৃষকদের একই অবস্থা জানা যায়।
চলমান প্রচ- তাপদাহে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে রোপা আমনের জমি। সূর্যের প্রখর তাপে পুড়ে যাচ্ছে ধানের জমি। কৃষকরা বলছেন, এই সময় রোপা আমনের জমি সবার লাগানো শেষ হয়ে যায়। অথচ ভাদ্র মাসেও বৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে অনেকেই সেচ দিয়ে জমি লাগিয়ে এখন বিপাকে আবার অনেকেই নিরুপায় হয়ে সেচ দিয়ে জমি এখন লাগাচ্ছে বৃষ্টি হবে এমন আশায়।। আবহাওয়ার এমন খামখেয়ালিপনা অনেকটা হতাশায় ফেলেছে কৃষকদের। কৃষকের সারা বছরের খোরাক জোগায় আমন ধান। তাই মনোযোগ সহকারে কৃষকেরা আমন ধান রোপণ এবং এর পরিচর্যা করে থাকে। যথাসময়ে বীজতলা সৃষ্টি করে ধান রোপণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আষাঢ় শ্রাবণ মাস পেরিয়ে গেলেও কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়ায় ধান রোপণ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকগণ। সারা উত্তরাঞ্চলে তীব্র তাপদাহে অস্থির রয়েছে সবাই।
এদিকে তীব্র তাপদাহের কারণে জনজীবনে অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একে তো বৃষ্টি নেই। তার উপরে কড়া রোদ্র এবং অতিরিক্ত গরমে জনজীবনে নাভিস্বাস হয়ে উঠেছে। প্রচন্ড গরমে একটু খানি শান্তির পরশ পেতে মানুষজন গাছের ছায়ায় আশ্রায় নিচ্ছেন। ঠিকমত বিদ্যুৎ সরবাহ না থাকায় অতিরিক্ত গরমের কারণে বাড়িতে অবস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রচন্ড গরমের কারণে মানুষের ভরসা হচ্ছে এখন আখের রস, ঘোল, ডাবের পানি ও লেবু পানি। রাস্তায় রাস্তায় এসব পণ্য কিনতে বা ক্ষেতে মানুষজনের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সুযোগে ডাবের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচন্ড গরমের কারণে মানুষজন ডায়ারিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ভ্যানচালক, মাটিকাটা শ্রমিক কিংবা যে কোন শ্রেণীর লেবাররা কাজের ফাঁকে ঠান্ডা পানিতে মাথা ভিজিয়ে কিংবা শরীর মুছে একটু প্রশান্তি পেতে চাইছে। জলবায়ুর হঠাৎ এমন বিরূপ প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে যেমন বড় প্রভাব ফেলেছে তেমনি কৃষিতে ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে।