মানিকগঞ্জে রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত আদর্শ কৃষক মো. বাবর আলীকে ফিরে দেখি

মানিকগঞ্জ থেকে মো. নজরুল ইসলাম
“কৃষি বাঁচাও কৃষক বাঁচাও দেশ বাঁচাও“ প্রকৃতি থেকে শিখি, তাই প্রকৃতিকেই ফিরে দেখি“ আমরা ফিরে দেখতে চাই সমাজের একজন আদর্শ কৃষক মো.বাবর আলীকে।


তিনি মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের বহুজা গ্রামের কৃতি সন্তান। তিনি প্রতিবেশীয় কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে সরকারি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ছাড়াও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক, এসডিআইসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে কৃষক নিয়ন্ত্রিত জাত গবেষণায় অবদান রেখেছেন। প্রবীণ কৃষক মো. বাবর আলী ব্রিটিশ আমলের ১৫ এপ্রিল ১৯৪৩ সালে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বহুজা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা- মৃত কলম বেপারী, মাতা- মৃত প্রভাতী বেওয়া, বানিয়াজুরী ইউনিয়নের বহুজা গ্রামে বেড়ে উঠলেও তিনি জয়নগর প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।


তারপর পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে কাপড়ের ব্যবস্যা, সেলাই কাজ, পাটের ব্যবসা শুরু করেন এবং পাশাপাশি কৃষি কাজের হাত ভালো থাকায় কৃষি কাজেও সফলতা অর্জন করেন। কৃষি কাজে অধিক সফলতা থেকে নেশায় পরিণত হলে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্যবসার দিকে মনযোগ না দিয়ে কৃষি কাজেই বেশি মনযোগী হন।


একজন আদর্শ কৃষক বাবর আলীর সাথে মৃত্যুর আগে কথা হলে জানা যায়, আসলে তাঁর বয়স ৭৫ পেরিয়ে গেলেও তবুও ক্লান্তির ছায়া নেই শরীরে। বয়সের বেশিরভাগ সময় কেটেছে তার কাজের মধ্যে দিয়ে। সারাদিন একটানা পরিশ্রম করেও ক্লান্তি ও উৎসাহের ঘাটতি নেই। তিনি বাড়িতে তৈরি করেছেন কৃষিভিত্তিক শতবাড়ী মডেল। বাবর আলীর আদর্শ কৃষি বা শত বাড়ীতে রয়েছে আম, পেঁয়ারা,কদবেল, লিচু, কাঁঠাল, আতা, জামবুরা, নুনাফল, জাম, কলা, বড়ই, পেঁপে, সজনে গাছ, নারিকেল, সুপারি, আমড়া, তাল, আমলকি, অর্জুন, নিম, আদা, হলুদ, পিঁয়াজ, লাল শাক, ডাটা শাক, পুই শাক, পালন শাক, লাউ, কুমড়া, শিম, বটবটি, ধুন্দুল, কচু, করলাসহ অসংখ্য অচাষকৃত উদ্ভিদ, যা তিনি জৈবভাবে উৎপাদন করেছেন। তার এ ধরনের কাজকে গতিশীল করতে সহায়তা করে আসছে বেসরকারী কৃষি গবেষণা সংস্থা বারসিক ও ঘিওর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার। বাবর আলী সরকারি বেসরকারিভাবে জীবনে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য জৈব কৃষিচর্চার উপর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। কৃষি কাজে তাঁর নিজস্ব লোকায়ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত লব্ধ জ্ঞান নিয়ে বিনামূল্যে অকাতরে তিনি কৃষি ও কৃষকের মাঠে ছুটে যাচ্ছেন। এভাবে তিনি নিজ বাড়িকে এবং তাঁর এলাকাকে আদর্শ কৃষি বাড়িতে তথা শত বাড়ির মডেলে পরিণত করতে আজীবন লড়াই করেছেন।


আদর্শ কৃষক মো: বাবর আলী জানান, তার কখনো মৌসুমভিত্তিক ফল, ফলাদি ও সবজির অভাব হয় না। নিজের বাড়ি থেকেই সকলের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত পণ্য বাজারে বিক্রি করেন। প্রতিবছর তিনি সবজি বাগানে সেক্স থেরোমিন ফাঁদ ঝুলিয়ে দেন, ধুপ দেন, বাসী ছাই দেন, পোকার হাত থেকে রক্ষা পেতে মেহগনি ফলের বালাই ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু ভুলেও কখনো রাসায়নিক সার বা কীটনাষক ব্যবহার করেন নাই।
তাঁর জৈব কৃষি চর্চা দেখে বহুজা গ্রামের নারী-পুরুষদের আগ্রহ দিন দিন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামের নারীরা তার কাছে এসে জৈর সার, কেঁচো কম্পোস্ট তৈরিসহ কৃষি কাজের নানা কলাকৌশল বা পদ্ধতি শিখে ধন্য হয়েছেন। তাঁর প্রতিবেশীরা বলেন বাবর আলীর স্বপ্ন একদিন যেন বহুজা গ্রামের সবাই জৈব পদ্ধতিতে ফসল ফলায় এবং মানুষকে যেন কৃষি বিষয়ে পরার্র্মশ দিতে পারে এই স্বপ্নই তিনি দেখতেন। নিজের শেষ জীবনে এসে মানুষের মাঝেই তিনি বেঁেচ থাকতে চেয়েছেন।


বহুজা গ্রামের কবির হোসেন জানান, ফসলাদী বিভিন্ন পোকার হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি কৃষক বাবর আলীর কাছ থেকে থেরোমিন ফাঁদ দিতে শিখেছেন। এছাড়াও কম্পোস্ট সার তৈরী প্রণালীসহ নানা কৌশল গ্রামের মানুষদের হাতে ধরে আজীবন শিখিয়ে গেছেন। বাবর আলী মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত নিজ গ্রামে সজনে গাছ রোপণের আন্দোলন করে গেছেন। তিনি মানুষদের বলতেন, ‘সজনে গাছ দ্রুত বড় হয় এতে অনেক পুষ্টিগুণ আছে, এই গাছ ঔষুধির কাজও করে।’ সজনে গাছ রোপণের কথা বলতে বলতে একসময় তার স্বপ্ন কিছুটা পূরণের তৃপ্তি পেয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর আগে বহুজা গ্রামকে সজনে গ্রাম ঘোষণা করেছিলেন ঢাকা খামার বাড়ির পরিচালক আ: আজিজ। তারপর তার নতুন চিন্তা গ্রামে বড়ই গাছ রোপণ করা, তাই এবার তিনি বড়ই এর বীজ রেখেছিলেন কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তিনি মৃত্যুর আগে এই স্বপ্ন দেখে যেতে পারলেন না।


একসময়ের ঘিওর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও বর্তমানে কৃষি সচিবালয়ের কর্মকর্তা কৃষিবিদ আশরাফ উজ্জামান বলেন, ‘এই সময়কালে বাবর আলী একজন অনুকরণীয় ও অনুসরনীয় আদর্শ কৃষক। তাঁর গ্রামেই শুধু নয়,আশেপাশের অনেক জায়গায় তিনি কৃষি উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি আমাদের জাতীয় সম্পদ তাই আগামী প্রজন্ম তাকে বারবার ফিরে দেখবে এই প্রত্যাশা করি।’


উন্নয়ন কর্মী সুবীর কুমার সরকার বলেন, ‘২০১৫ সালে বাবর আলীর সাথে বারসিক’র কাজের মাধ্যমে পরিচয় ও সম্পর্ক তৈরি হয়। তারপর একটানা কয়েক বছর ধরে বারসিক’র কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েন আপন প্রাণে। তিনি আমাদের ঘিওর অঞ্চল তথা জাতীয়ভাবে একজন সম্পদ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কৃষি কাজের পাশাপাশি বহুমাত্রিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন। যেমন- ধূইয়া গান, পিঠাউৎসব, রান্না প্রতিযোগিতা, অচাষকৃত উদ্ভিদের মেলা, সাজনের ডাল রোপণের মাধ্যমে সাজনে গ্রাম তৈরি , হাজল তৈরি, বট গাছের চারা রোপণ, বানিয়াজুরী বেড়িবাঁধে চারা রোপণ, তালের বীজ, খেজুর বীজ রোপণ, কলার জাত বৃদ্ধি, প্রবীণ সংগঠন তৈরি, করোনাকালে মাস্ক, খাদ্য সহায়তা, বৃক্ষ রোপণ ও বিতরণ, স্বাস্থ্য ক্যাম্প, কেঁচো সার তৈরী ও বিস্তার ইত্যাদিসহ অসংখ্য কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন।


উল্লেখ্য যে, তিনি গত ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ বার্ধক্যজনিত কারণে মানিকগঞ্জ কনের্ল মালেক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। মৃত্যকালে তার এক পুত্র সন্তান, স্ত্রী, নাতি, নাতিন মেয়ে রেখে পরপারে পারি জমান।


পরিশেষে বলতে চাই যে, সহসাই সমাজে একজন বাবর আলী তৈরি হয়না। একজন আদর্শ কৃষক বাবর আলী তাঁর কর্মের মাঝে চিরকাল বেঁেচ থাকবেন। তিনি কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে এবং স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থা বিনির্মাণে বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক চর্চার আন্দোলন করে গেছেন। এই সমাজে বাবর আলীদের অনেক অভাব, ভীষণ অভাব। আগামী প্রজন্মের জন্য বাবর আলী অবশ্যই অনুসরণীয় তাই তাকে আমরা বারবার ফিরে দেখি।

happy wheels 2

Comments