ফরিদা আক্তারের সমন্বিত কৃষিতে সফলতার গল্প

সাতক্ষীরা থেকে মুকুন্দ ঘোষ

পরিবারের অধিকাংশ কাজই নারীকে করতে হয়। বলা চলে শতভাগই নারীরাই করে থাকেন। সন্তান লালন-পালন থেকে শুরু করে সবার দেখভাল পর্যন্ত নারীকে করতে হয়। কিন্তু দিনশেষে নারীর কাজের কোনই মূল্যায়ন নেই। গৃহস্থালির কাজে নারী কোনোদিন অর্থমূল্য পায় না। এমনকি নারীরা তা আশাও করেন না। কিন্তু যা আশা করেন তা হচ্ছে মানসিক সহযোগিতা ও কাজের স্বীকৃতি। তবু এ সমাজে অধিকাংশ পুরুষই নারীর কর্মকে কাজের মধ্যেই ধরেন না। এমনকি নানা অনুযোগ-অভিযোগে কান ভারী করে তোলে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আজও নারীর কাজের কোনোই মূল্যায়ন নেই। নারীকে তার যোগ্য সম্মান ও মূল্যায়ন কোনটাই করা হয় না। বরং নারীর ওপর অভিযোগ ছুড়ে দেওয়া হয় ঘরে বসে সারাদিন করেটা কী! নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে একজন নারী তার পরিবারের জন্য সবটা বিসর্জন দেন। আমাদের সমাজে এমন অনেক মায়ের দেখা মিলবে যারা শুধু সন্তানের জন্য নিজের চাকরি ছেড়ে ঘরে বাচ্চা ও পরিবারকে সময় দেন। কিন্তু সেই নারীরাও তার মূল্যায়ন পান না। পরিবারের কেউই তার স্রেক্রিফাইজের জায়গাটা বোঝেন না।

আমাদের সমাজে শৈশব থেকেই মেয়েদের প্রতি যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা হয় তারা সেটাকেই ধারণ করে। ফলে মেয়ে ও ছেলের মধ্যে যে পার্থক্য ছোট থেকে মস্তিস্কে গেঁথে যায় তা আজীবন থাকে। নারীরা যে ঘরের কাজের জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে এমনটাই মনে করে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ। এমনকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেক নারী তাদের আজ্ঞাবহ থাকতেই পছন্দ করেন। এই ছত্রছায়ার বাইরে তার নিজস্ব জগৎ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। নারীদের কাজের মূল্যায়ন না হওয়ার ফলে সংসারে নানাবিধ সংকট দেখা দিচ্ছে। পরিবারের সবার মধ্যে সৌহার্দ্য কমছে। নারীর কাজের মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। ঘরে নারীরা যে কাজগুলো করেন সেখানে যতোটা সম্ভব পুরুষের সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। যদি সবসময় সম্ভব নাও হয় তবু নারীর কাজের প্রতি শ্রদ্ধাপরায়ণ হওয়া উচিত।

আমরা জানি, কাজের যোগ্য মূল্যায়ন পেতে কার না ভালো লাগে! পুরুষ সারাদিন কাজ করে আসার পর তার দেখভাল করার জন্য নারী থাকেন। কিন্তু একজন নারীকে দেখভাল করার জন্য কখনও পুরুষ তার হাতটা বাড়িয়ে দেন না। এমনকি ছুটির দিনটাও পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে সময় কাটান না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। দেখা যায়, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই পার করেন। তবে নারীরা কখনোই সংসারকে তুচ্ছ করে বাইরের জগতে বিচরণ করেন না। বরং তারা সবটা গুছিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন।

কিন্তু এই কাজগুলো নারীর জন্য বাধ্যতামূলক করেছে এই সমাজ। পুরুষের জন্য নয়। তারা বাইরে সামলে আসলেই সাত খুন মাফ। তবু নারীর এই কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই এ সমাজে। সবার দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে, তাদের ক্লান্তি নেই। দুঃখ নেই। তারা পৃথিবীতে সবটা বিসর্জন দিতেই এসেছেন, দিন পাল্টাচ্ছে। এখনও যদি নারীকে তার প্রাপ্য মূল্যায়ন করা হয় তবে সমাজ এগিয়ে যাবে। নারীরাও মুক্তি পাবে। আর জীবন যুদ্ধে হার না মানা এমনই একজন নারী ফরিদা আক্তার।

সাতক্ষীরার জেলার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনের কোলঘেসা ইউনিয়ন গাবুরাতে বাস ফরিদা আক্তারের। ফরিদা আক্তার (৪৫) এর বিয়ে হয়েছিলো (১৩) বছর বয়সে। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে বেশিদূর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। তাঁর স্বামী ফজলুল হক (৬৫) পরিবারের হাল ধরতে তার খুব বেশি পড়ালেখার সুযোগ হয়নি। তাঁর স্বামীর বার্ধক্যজনিত কারণে এখন আর কাজ করতে পারেন না। ফরিদা আক্তার দুই কন্যা সন্তানের জননী। বড় মেয়ে হাফিজা পারভিন (৩০) ছোট মেয়ে আমেনা খাতুন (২৫)। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে।


২০২১ সালের অক্টোবর মাসে নেটজ্ পাটনারশিপ ফর ডেভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় পরিবেশ পদক প্রাপ্ত সংগঠন বারসিক’র বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে মধ্যোমখলিসা বুনিয়া গ্রামের মালঞ্চ দলে যুক্ত হয় ফরিদা আক্তার। পরিবার উন্নয়ন পরিকল্পনায় ছাগল নিলে পরিবারের আয় বাড়বে উল্লেখ করে হাফিজা খাতুন। বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে সহায়তা হিসেবে তিনটি ছাগল, দুইটি গাছের চারা সাত প্রকারের বীজ ও দশটি মেরি হাঁস পান। ফরিদা আক্তার নিজের বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ ও হাঁস পালন করে নিজের পারিবারিক খরচ মিটিয়ে দলে সঞ্চয় জমা করেন কিছু টাকা।

oplus_0


ফরিদা আক্তারের কাছে সমন্বিত কৃষি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, বারসিকের থেকে জলবায়ু সহনশীল কৃষিচর্চা বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং নিয়মিত মিটিং থেকে লবণ সহনশীল সবজি চাষ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পেরে সবজি চাষ, হাঁস ও ছাগল পালন করে সফল আমি।’


ফরিদা আক্তারের বসতভিটার সবজিতে সার হিসাবে গর্ত কম্পোস্ট সার ব্যবহার করেন। এর ফলে সবজি উৎপাদনে পানি খরচ কম হয় এবং সার খুবই কম খরচ হয়। বালাইনাশক হিসাবে বিভিন্ন প্রকার জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করেন। তাঁর বাড়িতে চারটি ছাগল ১৫টি হাঁস আছে। সবজি ক্ষেতে বিভিন্ন প্রকার সবজি আছে। ফল গাছ হিসাবে আছে নরিকেল, খেজুর, কদবেল, জামরুল, কুল, পেয়ারা, ইত্যাদি। তিনি জানান, এখান থেকে পারিবারিক সবজি চাহিদা পূরণ করে বাকিগুলা বিক্রি করে পরিবারে অন্যান্য খরচ বহন করে ও একটু একটু সঞ্চয় জমা করেন।

ফরিদা আক্তার এ বিষয়ে জানালেন, “বারসিক থেকে সহায়তা পেয়ে এবং জলবায়ু সহনশীল প্রশিক্ষণ পেয়ে ও নিয়মিত মিটিং থেকে অনেক বিষয় জানতে পেরে নিজে কৃষি কাজটাকে খুব ভালোভাবে করতে পারছি। বারসিককে কৃতজ্ঞতা জানাই।’

happy wheels 2

Comments