পরিবেশবান্ধব চুলা বাঁচায় পরিবেশ, বস্তিজীবনে ফোটায় হাসি

রাজশাহী থেকে দেবশ্রী মন্ডল ছুটু

রাস্তার পাশের ছোট খুপরী ঘরগুলোতে থাকে যে মানুষগুলো তাদের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্যই হচ্ছে তিনবেলা পেটের খাবারের সন্ধান করা। এই মানুষগুলো মানবেতর জীবনে কোথাও পাননা সম্মান, মর্যাদা, অধিকার। জীবনের মৌলিক অধিকারগুলোই কদাচিৎ এদের পূরণ হয়! তাই না পাওয়ার বেদনা তাঁদেরকে কুড়ে কুড়ে বিদ্ধ করেছে। তাই তাদের সাথে আপনার মিথষ্ক্রিয়া সেটা হোক না মিষ্টি কথা, সচেতনতার কথা বা অধিকারের কথা সেটার একটি মিশ্র প্রতিবার্তা পাবেন তাতে নিশ্চিত। কেউ হয়তো আপনার কথায় পাত্তা দেবে না, কেউ আপনাকে বোকা ভাববে, আপনার কথা শুনে হাসবে, আবার কেউ কেউ হয়তোবা আপনার কথায় প্রভাবিত হবে।
sam_7955
অধিকারহীন ও প্রাপ্তিহীনতার সাথে বসবাসের কারণেই রাজশাহীর নামোভদ্রা বস্তির এ সব মানুষের অনুভূতিগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাঁরা খুব বেশি মাত্রায় দৃশ্যমান কিছু আশা করে আপনার কাছে। তাই তাদের সাথে আমার মিথষ্ক্রিয়ার ব্যাপারটি খুব সহজ ছিলো না! কেননা আমি দৃশ্যমান কোন কিছু নিতে পারিনি সাথে করে বরং তাদের গল্প শোনার জন্য বিমূর্ত উপকরণ তথা অধিকার, সচেতনতা এবং উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শই একমাত্র সম্বল আমার। তাই প্রথমে কেউই ভালোভাবে আমার সাথে কথা বলেনি। দুটো তিনটে কম বয়সী মেয়ে আমার আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছে। ওদের সাথেই শুরু করি আলাপচারিতা খুব সাবধানতার সাথে! এভাবে একে একে অনেকের সাথে কথা হয়। সবার সাথে কথা বলার সুযোগ মেলে পনের দিনের পর। কারণ আমি ততদিনে অনেকটা পরিচিতি মুখ তাদের কাছে! আমি শুরুই করি ছোট প্রশ্ন দিয়ে যেমন দেশের বাড়ি কোথায়, কেন এখানে আসা, পরিবারে কে কে আছে, সংসার চলে কি করে, ভবিষ্যৎ এ কোথায় থাকার ইচ্ছে,কি কাজ করেন এইসব। এই ছোট প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে গভীর আলোচনায় প্রবেশি করি।
sam_8266
আলাপচারিতার ধারাহিকতায় আমার জানা হয় এ বস্তির অধিকাংশ মানুষের পেশাই হলো ময়লা কুড়ানো তাদের ভাষায় যা ‘ভাঙড়ি কুড়ানো’ নামে অধিক পরিচিতি। অন্যদিকে কম বয়সী ছেলেরা বাসের হেল্পার, কেউ কেউ রিক্সা চালায়, শিশু এবং বৃদ্ধরা ভিক্ষা করে, কিশোরীরা অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে দুটো তিনটে করে বাচ্চা সামলাতেই দিন পার করেঅ অন্যদিকে মাঝ বয়সী মহিলারা কেউ ভাঙড়ি কুড়ায়, কেউ ভিক্ষা করে আবার কেউ ছোট চায়ের দোকান খুলেছে। সারাদিন বিভিন্ন ডাস্টবিন আর শহরের অলিগলি ঘুরে  তারা কুড়িয়ে আনেন হরেক রকম জিনিস। ছেঁড়া কাগজ, ভাঙ্গা প্লাস্টিকের জিনিস, পুরাতন কাপড়, ফেলে দেয়া ব্যাগ, স্যান্ডেল, বোতল, পলিথিন ব্যাগ সবকিছুই তারা নিয়ে আসে যা তাদের কোন না কোন কাজে লাগে। বিক্রি করার জন্য তারা মৃত পশুর হাড় কুড়িয়ে নিয়ে আসে। এই ভাঙড়ি কুড়াতে গিয়েই তারা কুড়িয়ে নিয়ে আসে রান্না করার জ্বালানিও। শুকনো ডাল, ছেঁড়া কাপড়, ঝুটা, পলিথিন, কাগজ, স্পঞ্জের স্যান্ডেল , প্লাস্টিকের পাইপ যা কিছুই পোড়ানো যায় তাই এদের রান্নার জ্বালানি হয়।

কুড়িয়ে পাওয়া জ্বালানি দিয়েই যে তারা রান্না করেন সেটা তারা অনেক সময় জানাতে চান না! তাই আপনি যদি প্রশ্ন করেন কি দিয়ে রান্না করেন? তারা আপনাকে জানাবে ‘খড়ি কিনে রান্না করি আমরা’। তবে আপনার আলাপচারিতা যদি আন্তরিক হয় তাহলে তারা আপানাকে জানাবে যে, ময়লা কুড়ানোর পাশাপাশি তারা জ্বালানিও সংগ্রহ করে। এভাবেই জমেলা নামের একজন বললেন, “আমি সবকিছু দিয়ে রান্না করি। বেশি রান্না করি ঝুট, তেনা (ছেঁড়া কাপড়), কাগজ আর খড়ি দিয়ে। তবে প্লাস্টিকের পাইপ, টায়ার, স্পঞ্জের স্যান্ডেল, পলিথিন এসব দিয়ে ও রান্না করি। মাঝে মধ্যে কিছু পাইপ আর স্পঞ্জের স্যান্ডেল দিয়ে রান্না করার সময় খুব গন্ধ বের হয় আর বিষাক্ত ধোঁয়ায় চোখ –মুখ জ্বালা করে মরিচের ঝালের মতোই।” এই অভিজ্ঞতা তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই আছে। একথা আস্তে আস্তে সবাই বলল। তারপর নিস্তেজ গলায় নিজেরাই বলেন “কি করব আপা,খড়ি কেনার কি আর টাকা হয় সবসময়।” বললাম, “যদি আপনারা রান্নার জন্য ভালো চুলা ব্যবহার করেন তাহলে হয়তো আপনাদের রান্না তাড়াতাড়ি হবে ধোঁয়ায় চোখ মুখ ও কম জ্বালাপোড়া করবে। বললাম এক ধরনের চুলা আছে যাকে বলে পরিবেশবান্ধব চুলা। সেই চুলা ব্যবহার করলে সমস্যাগুলো কিছুটা কমবে। প্রায় সমস্বরে সবাই বললেন, “কত টাকা লাগবে আপা? ” তারপর কি যেন চিন্তা করে তাঁরা বললেন, “আমরা তো টাকা পয়সা দিতে পারবো না আপা।”
sam_8302
অর্থকষ্ট তাদের সবসময়ই থাকে। অনিশ্চিত একটি আয়ের উৎসের কারণেই তারা অর্থব্যয়কে ভয় পান ভীষণভাবে। বিষয়টি আঁচ করে আমি বললাম, “এই চুলা তৈরি করতে আপনাদের শুধু মাটি জোগাড় করতে হবে আর একটা করে সিমেন্টের পাইপ লাগবে।” অবশ্য পাইপ কেনার জন্য কেউ কেউ পঞ্চাশ টাকা করে দিতে চাইল। এভাবে তাদের সাথে আলাপচারিতায় আমরা নামোভদ্রা বস্তির প্রতিটি পরিবারেই পরিবেশবান্ধব চুলার তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরিতে পারদর্শী কবুলজান বেগমকে নিয়ে তাদের সাথে একদিন বিকেলে বসা হল। তারা কে কে চুলা তৈরি করতে পারে, কে কে উন্নত চুলা তৈরি শিখে নেবে এবং তাদের বাসায় তৈরি করবে তার একটা তালিকা তৈরি করা হলো। একটা দিন ঠিক করা হলো যেদিন তারা সবাই বাসায় থাকবে। সেদিন কবুলজান আসবেন এবং তাদেকে পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরি করবেন এবং এ চুলা তৈরির প্রশিক্ষণ দেবেন। এভাবে নিদির্ষ্ট দিনে তাঁরা চুলা তৈরির মাটি জোগাড় করে এবং বারসিক কাছ থেকে সিমেন্টের পাইপ পেয়ে কবুলজান বেগম তাদেরকে পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরি করে দেন এবং এ চুলার তৈরির কৌশল শিখান। কাবুলজান বেগম নিপুণ হাতের দক্ষতায় বস্তিবাসীদের জন্য সারাদিনে ছয়টা চুলা তৈরি করলেন। আর চুলা তৈরি শিখে নিল প্রায় দশ থেকে বারো জন নারী। পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরির দিনে বস্তিজুড়ে যেন উৎসবের ধুম পড়ে গেল। কার বাসায় গিয়ে আগে শেখাবে তার প্রতিযোগিতা লেগে গেল। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট নয় তাঁরা। কাবুলজানকে কথা দিতে হলো যে তিনি আরও একদিন আসবেন তাদের জন্য। সারাদিন ছিল বস্তিজুড়েই আনন্দ আর খুশি। এ চুলা পেয়ে এবং তৈরির কৌশল জেনে বস্তিবাসীরা খুবই আনন্দিত। কারণ এ চুলা ব্যবহার করে তাদের জ্বালানি কম লাগবে, ধোঁয়া কম আসবে। এতে করে জ্বালানির সাশ্রয় হবে এবং স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।

happy wheels 2