বহু গুণের কলমী শাক
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
কেউ বলে আজাবা, কেউ বলে বুনো, কেউবা বলে জলকলমী, আবার কেউ বলে খোটা শাক। গ্রামীণ মানুষের কাছে এটি শাক হিসেবেই পরিচিত। বিনা চাষে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া এ উদ্ভিত মানুষের খুবই আপন। তবে অঞ্চলভেদে এর পরিচিতি বেশ খানিকটা ভিন্ন। কোন অঞ্চলে পরিচিতি লাভ করে আপনজ্বালা হিসেবে কোথাও জংলী শাক হিসেবে। তবে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া এ সমস্ত উদ্ভিদ লতা-পাতা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও চিকিৎসা পদ্ধতিতে যেমনি রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তেমনি এনেছে সমৃদ্ধি। আজাবা, বনজ এই উদ্ভিদটির নাম কলমী শাক। কলমী শাক আমাদের দেশজ একটি অচাষকৃত উদ্ভিদ।
শেকড় থেকে শীর্ষ পর্যন্ত কলমী শাকের মোট দৈর্ঘ্য ৪৮ সেঃ মিঃ। পাতার দৈর্ঘ্য ১২.৫ সেঃ মিঃ, রঙ সবুজ, ত্রিকোনাকৃতির পান পাতার মতো তবে লম্বাটে। ফুলের দৈর্ঘ্য ১৩.৫ সেঃ মিঃ, রঙ সাদা, আকৃতি মাইকের মতো। ফুলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট একটি পাঁপড়ি বিশিষ্ট তবে মাথার দিকে পাঁপড়ি ৫টি ভাগে বিভক্ত। ফলের দৈর্ঘ্য ৭.৫ সেঃ মিঃ, রঙ ঘিয়ে। আর্দ্র মাটিতে কলমী শাক ভালো জন্মায়। গ্রাম বাংলায় কলমী শাক এখনও প্রচুর মেলে। এই শাক খুবই পরিচিত। পানিতে অর্থাৎ জলাশয় (বিল, পুকুর, ডোবা, খাল, কনকনা, বেড়) প্রভৃতি জায়গায় হয়, আবাদ করতে হয় না। যখন তরকারি না থাকে তখন অনেকেই এই শাকটা বেশির ভাগ সময় খেয়ে থাকেন। এই শাক মাছ দিয়ে রান্না করা হয়। আবার ভাজিও করা যায়। অনেকে পাতা ভর্তা করে খায়।
ভেষজের জগতে এই শাকের রয়েছে দুর্লভ সব ওষুধি গুণ। ছোট বাচ্চাদের ও গর্ভবতী মায়েদের বেশির ভাগ এ শাক খেতে দেয়। কারণ এই শাকে প্রচুর ভিটামিন আছে। শাস্ত্রে রয়েছে ষড়ঋতুর রোগ প্রতিরোধ করে কলমী শাক। এ কারণে আবহমান বাংলায় কলমী শাকের চাষ হতো গৃহস্থ বাড়ির কাছেই, যাতে হাত বাড়ালে পাওয়া যায়। যদি কারও ফোঁড়া ওঠে এই শাকের পাতা তুলে একটু আদাসহ পাটায় পিষে ফোঁড়ার চারপাশে লেপে দিয়ে মাঝখানে খালি রাখতে হবে। তিনদিন এইভাবে লেপে দিলে ফোঁড়া গলে যাবে এবং রস বের হয়ে শুকিয়ে যাবে। বাগি বা ফোঁড়া উঠলে পাতা বেটে প্রলেপ দিলে বাগি মিশে যাবে। রাতকানা রোগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই শাক কয়েক সপ্তাহ প্রতিদিন একবেলা ভাজি রান্না করে খেলে রাতকানা রোগ ভালো হয়। বাচ্চারা যদি মায়ের দুধ কম পায় সেই ক্ষেত্রে কলমী শাক ছোট মাছ দিয়ে রান্না করে খেলে মায়ের দুধ বাড়বে। কোষ্ঠকাঠিন্য বা আমাশয় হলে কলমী শাক তুলে ছেঁচে এক পোয়া রস আঁখের গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে সকালে বিকালে এক সপ্তাহ খেলে ভালো উপকার পাওয়া যায়। গর্ভ অবস্থায় গর্ভবতী মায়েদের শরীরে, হাতে ও পায়ে রস আসে। সেই সময় কলমী শাক বেশি করে রসুন দিয়ে ভেজে তিন সপ্তাহ খেলে পানি কমে যাবে। হাত-পা, শরীর জ্বালা করলে কলমী পাতার রস করে একটু দুধ মিশিয়ে সকালে খালি পেটে এক সপ্তাহ খেলে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া বোলতা/বল্লা, ভীমরুল ও মৌমাছি প্রভৃতি হুল ফোটালে অনেক সময় ব্যথা দীর্ঘসময় স্থায়ী হয়। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে কলমী শাক বেটে লাগানো যেতে পারে। দ্রুত ব্যথা কমে যায়। পিঁপড়া ও বিছা কামড়ালে এই শাকের ডোগাসহ রস করে লাগালে যন্ত্রনা কমে যাবে।
প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কলমি অন্যান্য উদ্ভিদের ন্যায় বর্তমানে এই উদ্ভিদও হারানোর পথে। প্রাকৃতিক জলাশয়ের পরিমাণ কমে যাওয়া, লবণ পানির ব্যবহার ও আধুনিক কৃষির প্রভাবে দিনে দিনে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ব্যবহারিক দিক কমে যাওয়া, সংরক্ষণের অভাব উদ্ভিদটি বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থা ও আধুনিক খাদ্যাভ্যাস এই উদ্ভিদ বৈচিত্র্য বিলুপ্তির জন্য অনেকাংশে দায়ী। এ সমস্ত উদ্ভিদ আমাদের খাদ্য চাহিদা পূরণে যেমন ভূমিকা রাখে তেমনি ভূমিকা রাখে আমাদের চিকিৎসা কাজে। আমাদের আগামীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাই জরুরি এই উদ্ভিদের জন্ম উৎস সংরক্ষণ ও ব্যবহার বাড়ানো। তাহলে যেমন রক্ষা পাবে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য, তেমনি স্থায়িত্বশীল জীবন গঠনেও ভূমিকা রাখবে।