বালি জমিতে ফসল উৎপাদন করে সফল স্বপন মানখিন
কলমাকান্দা, নেত্রকানা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
বালি যেমন একটি সম্পদ তেমনি প্রতিবেশগত কারণে কারো কারো জন্য এটি দূর্যোগও। বালি দূর্যোগের কারণ হয় তখনই যখন কোন কৃষকের জীবিকার অবলম্বনে আঘাত করে ও ফসল উৎপাদনের পথ রুদ্ধ করে দেয় চিরদিনের মত। সার্বিকভাবে বিপদাপন্ন করে তুলে কৃষকের পেশাকে ও তার খাদ্য নিরাপত্তাকে। বালি দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মধ্যে চন্দ্রডিঙ্গা একটি। এই গ্রামের জনগোষ্ঠীদের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দু’টো দূর্যোগই মোকাবিলা করতে হয় প্রতিবছর। ভারতের অবকাঠানো উন্নয়নের জন্য পাহাড় কাটার ফলে মানবসৃষ্ট বালি দূর্যোগটি স্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে এই এলাকায়। যাদের ফসলী জমি বালিতে ভরাট হয়ে গেছে সেই জমিগুলো পতিত পড়ে আছে আজ থেকে প্রায় ৪ বছর ধরে। সবারই একই ধারণা এই ঝুরঝুড়ে বালির মধ্যে কোন ফসল হবে না। কিন্তু মাটির এই বন্ধ্যাত্ব মেনে নিতে পারছেনা কৃষক স্বপন মানখিন ও তার পরিবার। তাই সেই বালির মধ্যেই তারা প্রথমবারের মত উদ্যোগ নিয়েছেন পরীক্ষামূলকভাবে ফসল চাষ করার। কারণ এই বালি মাটিই তাদের জীবিকার অবলম্বন।
গত ২০১৫ সালে স্বপন মানখিনে স্ত্রী বেনুকা ¤্রং তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ৮-১০টি বাদামের বীজ নিয়ে এসেছিলেন। সেই কয়েকটি বীজ তিনি তার বাড়ির সামনে অযত্নে পড়ে থাকা বালি মাটিতে বপন করে দেন পরম মমতায়। উপযুক্ত সময়ে সেই প্রাণহীন, নিরস ও অনুর্বর মাটিতে অংকুরোদগমন হয় সেই বীজটি। কিন্তু চারদিকে গবাদি পশুর অবাধ বিচরণের কারণে বাদাম চারটি বড় হওয়ার সাথে সাথে গবাদি পশু খেয়ে ফেলে। মনটা খারাপ হলেও তিনি এতে আশা দেখতে পাচ্ছেন যে, এই বালি জমিতে কিছু না কিছু ফলানো যায়।
সেই থেকেই এই বছর স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে তাদের বাড়ির সামনে প্রায় ৩ শতাংশ বালি জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে কম সেচে চাষ করা যায় এমন ফসল যেমন বাদাম, মিষ্টি আলু, ক্ষেত শিম, পেঁয়াজ, রসুন, বেগুন, ভূট্টা চাষ করছেন। পাশাপাশি একই ফসল তিনি তুলনামূলকভাবে ভালো মাটিতেও চাষ করেছেন দুই ধরনের মাটিতে ফসলের উৎপাদন, বেড়ে ওঠার সময়কাল, পোকার আক্রমণের ধরন প্রভৃতি যাচাই করার জন্য। ফসল রক্ষার্থে তিনি বসতবাড়ির চারদিকে বেড়া দিয়েছেন। এই বালি মাটিতে ফসল উৎপাদনের জন্য তারা শুধুমাত্র গোবর ব্যবহার করছেন। পোকা দমনের জন্য শুধুমাত্র ছাই ব্যবহার করছেন। পানির সমস্যা সমাধানের জন্য বাড়ির সামনেই ছোট্ট কুয়া খনন করেছেন। পানি শুকিয়ে গেলে কুয়াটি আরেকটু গভীর করে খনন করে দেন যাতে পানি পাওয়া যায়। এইভাবে তারা পানির সমস্যা সমাধান করছেন।
বালি মাটিতে ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁদের। সেই সম্পর্কেই স্বপন মানখিন বলেন, “ভালো মাটিতে যেমন ফসল হয় তেমনি বালি মাটিতেও হয়। তবে কিছুটা পার্থক্য আছে। বালি মাটিতে গাছ বাড়তে দেরি হয় ও গাছ কম বাড়ে। পোকাগুলোও আলাদা।” তিনি আরও বলেন, “বালি মাটির পোকা বালির ভিতরে থেকে বীজ, চারাগাছ ও গাছের শিকর কাটে যা দমন করা কষ্টকর। গাছের পাতা, ফুল ও ফলে পোকা ধরলে ছাই দিলেই হয়। কিন্তু মাটির ভিতরের পোকা সহজে দমন করা যায় না। কোন সময় কাটে তাও টের পাই না। শুধুমাত্র গাছ মরে গেলে বুঝা যায়। ফসল তোলা শেষ হলে এই পোকা দমনের চেষ্টা করব। এই বালি মাটিতেই কিছু চাষ করে আমাদের টিকে থাকতে হবে।”
বালি মাটিতে অভিযোজন করার জন্য এই পরিবারটি এই এলাকার জন্য একটি উদাহরণ। তাদের এই কার্যক্রমের মাধ্যমেই আরো অনেক কৃষকের সাথে তাদের যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের অভিজ্ঞতা তাঁরা অন্যদের সাথেও সহভাগিতা করছেন। তাঁদের সফল উদ্যোগ দেখার জন্য অনেক মানুষ তাদের কাছে আসেন বলে তারা জানান। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেও নেপালের ডেন চার্চের প্রতিনিধি একজন নেপালি নাগরিক, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, আরডিআরএস ও ডিএসকের কর্মীবৃন্দ পরিদর্শন করেছেন তাদের জমি ও জানার চেষ্টা করেছেন তাদের ফসল উৎপাদনের কৌশল। তাঁদের এই সফল উদ্যোগ আগামীতে আরো অনেক কৃষক বালি জমিতে ফসল চাষে উদ্যোগী করে তুলবে বলে তাঁরা মনে করেন।