দেশি জাতের ধানের নাম বৈচিত্র্য
ঢাকা থেকে কৃষিবিদ এবিএম তৌহিদুল আলম
এ দেশে এক সময় হাজার হাজার রকম দেশি ধান জাতের আবাদ করা হতো। গত শতাব্দীর পাঁচ বা ছয়ের দশকেও এ দেশে এদের সংখ্যা ছিল বেশ কয়েক হাজার। এখন থেকে আশি বছর আগে বিশিষ্ট ধান বিজ্ঞানী ড. পি হেক্টর এ দেশে বিভিন্ন মৌসুমে আবাদী ধানের স্থানীয় জাতের সংখ্যা ১৮,০০০ বলে উল্লেখ করেছেন। ১৯৮২ সালে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আব্দুল হামিদ ও তার সহযোগিদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের শুধু কিশোরগঞ্জ কৃষি জেলা বাদে বাংলাদেশের পুরো ২০ টি জেলায় তখনকার ৪৩৩ থানার মধ্যে মোট ৩৫৯ টি থানার ইউনিয়নগুলো হতে সংগৃহীত দেশি ধান জাতের একটি নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, সে সময় এদেশে প্রায় ১২,৪৮৭ টি স্থানীয় জাতের আবাদ করা হচ্ছিল। কোনো কোনো জাতের নাম একাধিকবার এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত এবং একই জাতের ভিন্ন ভিন্ন রকম জাত থাকায় সঠিক জাতের সংখ্যা অবশ্যই এর চেয়ে বাস্তবে কম ছিল। তবে অনুমান করা যায়, সে সময়েও এ দেশে কমপক্ষে হাজার ছয়েক দেশি ধান জাতের আবাদ করা হতো।
এই যে এত বিশাল সংখ্যক ধানের জাত আমাদের কৃষকরা উদ্ভাবন করেছেন। এদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। কোনো কোনো নাম এত সুন্দর আর অর্থবহ যে আমাদের পূর্ব পুরুষদের নান্দনিকতা বোধ আমাদের অবাক করে। কোনো কোনো জাতের প্রধান বৈচিত্র্য নামের মধ্য দিয়েই উদ্ভাসিত। এসব মনোহরা এক একটি নাম স্থানীয় জাতগুলোর যে এদের নাম বৈচিত্র্য যে কোনো মানুষকেই মুগ্ধ করবে। কোনো কোনো নাম এমন যে, নামেই তার গুণের প্রকাশ। ধানের জাতের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। নামও তাই ছিল এদের হাজার হাজার রকম। এই নাম দিয়ে কৃষক চিনে নিতেন তার আকাঙ্খার ধানজাতটিকে। পরম যতেœ বুনে দিত এসব বীজ মাঠে। আবার ঠিকঠাক পরের বছর মাঠে বুনে দেবার জন্য জাতটির বীজকে আলাদা করে করে সংরক্ষণ করতেন কৃষক। সংখ্যা যখন হাজার হাজার তখন তাদের নাম যে বিচিত্র হবে সেটাইতো স্বভাাবিক। এত নাম খুঁজে পাওয়া তো সহজ ছিল না। তবুও আমাদের পূর্ব পুরুষরা প্রতিটি জাতের ভিন্ন ভিন্ন সব নাম দিয়েছেন।
দেশি জাতের ধানের নামকরণের বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। কতভাবেই না এক একটি জাতকে অন্য জাত থেকে নানা রকম নামের মাধ্যমে আলাদাভাবে চেনানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কখনো অতি প্রিয় জাতটিকে অতি আদরের নাম দিয়ে অন্য জাত থেকে আলাদা করা হয়েছে। কখনো একেবারেই ভিন্ন রকম একটি নাম দিয়ে এক জাতকে অন্য জাত থেকে আলাদা করা হয়েছে। নানা বর্গের ধানকে বোঝানোর জন্য নানা রকম উপমার মাধ্যমে নামকরণ করা হয়েছে। ফুলের নাম, ফলের নাম, নানা রকম ফসলের নাম কিংবা অন্য ফসলের জাতের নামের সাথে মিল রেখে রাখা হয়েছে কত ধানের জাতের নাম। ঋতুর নাম, বস্তুর নাম, মাছের নামেও রয়েছে কোনো কোনো ধান জাত। সবজির নাম আর পাখির নামও বাদ যায়নি। পশুর নাম জুড়ে দিয়ে রাখা হয়েছে কত জাতের নাম। বাদ যায়নি নদীর নামও। অনেক ধান জাত রয়েছে যাদের নামকরণ করা হয়েছে স্থানের নাম অনুসারে। হুবহু মানুষের নাম দিয়েই হয়েছে কোনো কোনো জাতের নাম। বীজের আকৃতি বোঝাতেও নামকরণ হয়েছে কোনো কোনো জাতের। এমনকি বারের নামও বাদ যায়নি নামকরণে। কখনো আবার পছন্দের ধানকে কত যে আদুরে নাম দিয়েছে আমাদের পূর্ব পুরুষরা তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
বেশ আদর করে যে ফুলের নামেই কোনো কোনো ধানের নামকরণ করা হয়েছে তা অনুমান করা চলে। অনেকগুলো আউশের জাতের নামই রাখা হয়েছে ফুলের নামে। জবা ফুল, মরিচফুল, সূর্যমুখী, বাঁশফুল, কদমফুল, কামিনী, নয়নতারা, লেবু ফুল এমনিতর এক একটি নাম রয়েছে ধানের। এসব যে ধানের নাম তা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। অথচ এক সময় দিব্যি এ নামেই এসব ধানকে আলাদাভাবে শত শত হাজার হাজার বছর বাঁচিয়ে রেখেছিলেন আমাদের কৃষকরা। সরাসরি ফলের নামেও রয়েছে ধানের নাম। লিচু, জামরুল, কামরাঙা, ডমুর, বাদাম ইত্যাদি। ফলের নামের সাথে অন্য নাম জুড়ে দিয়েও নামকরণ করা হয়েছে কোনো কোনো জাতের। মরিচপাল, নারিকেলবেদি, খেজুর ঝোপা এমনি সব ধান জাত। কোনো কোনো ধান জাতের নাম এসেছে সরাসরি সবজির নাম থেকে কিংবা সবজির নামের সাথে অন্য নাম জুড়ে দিয়ে। কুমড়া, বেগুন, হাসি কুমড়া, কুমড়াগৈড়, ষাটকুমড়া, আশাকুমড়া এসব হলো ধানের জাতের নাম। অন্য অনেক ফসলের নামের সাথে মিল রেখেও ধানের নামকরণ করা হয়েছে। পানবর, মরিচাবুটি, মরিচাডুলি, সোনামুগ, বাদাম, মরিচপাল, কাঁচা হলুদ, তিল বায়াল, খৈয়া মটর- এসবও ধান জাতেরই নাম। নানা রকম বৃক্ষের নামেও রাখা হয়েছে কোনো কোনো ধানের জাতের নাম। বট, বাগ তুলসি, পাথরকুচি, বাঁশপাতা, বটশাইল, কেওড়া তেমনি তার কিছু উদাহরণ। শাকের নাম, পোকার নাম, ওষধি গাছের নাম কিংবা মশলার নামও বাদ যায়নি নামকরণে। সে কারণেই ধানের নাম রাখা হয়েছে কচু, মৌমাছি, ঘৃতকাঞ্চন কিংবা এলাচি। মাছের নাম সংযুক্ত করে নাম পেয়েছে ধানের কত নাম। কৈঝুরি, রুই, কইয়াবোরো এমনতর ধানের নামও রয়েছে কিছু।
সরাসরি পশুর নামেও রয়েছে কোনো কোনো জাতের নাম। গয়াল, বকরি এমন কিছু ধানের জাত। পশুর নামের আগে বা পিছে অন্য শব্দ জুড়ে রাখা হয়েছে কোনো কোনো জাতের নাম। বকরি মাথা, শিয়াল লেজি, মহিষ বাতান, বুড়া হরিণ, মহিষ দল, হনুমান জটা, হরিণ কাজলি, মহিষপাল ইত্যাদিও ধানের জাতের নামই। পাখির নামেও তো রয়েছে ধানের নাম। ঘুঘু শাইল, চড়–ই, ময়না, বকফুল, মাছরাঙা ইত্যাদি জাতের সাথে জড়িয়ে রয়েছে পাখির নাম। মানুষের নামের সাথে মিল রয়েছে কত কত জাতের নাম। মইরম বা মরিয়ম, নিপা, মানিক মোড়ল, কবির মনি, ফুলমতি, মানিকমন্ডল, কামাই মল্লিক, কাঞ্চন বিবি তেমনি সব উদাহরণ। স্থানের নামেও নাম পেয়েছে কোনো কোনো ধান জাত। বটেশ্বর, ভাউয়াল, হাতিয়া, পটুয়াখালী, ফরাস ডাঙা, লক্ষীপুরা, ময়নামতি জাতগুলো স্থানের নাম থেকেই নাম পেয়েছে। সংখ্যা দিয়েও নামকরণ করা হয়েছে কোনো কোনো ধান জাতের। অবাক হতে হয় ভেবে কেন ধানের নাম হয়েছে বাইশ বিশ, আড়াই বা শুধু বাইশ। দেশি জাতের ধানের সংক্ষিপ্ততম নামটি আসলে এক অক্ষরের। ভাবলে অবাক লাগে কেন ধানের নাম “নি”।
আমাদের দেশি ধানের বর্ণ বৈভব বিশাল। ধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বর্ণকে নিয়ে তাই নানা রকম নামকরণ করা হয়েছে। কালো বর্ণের মধ্যেও যে পার্থক্য রয়েছে তা বোঝাতে কালোর সাথে কত শব্দ জুড়ে দিয়ে এসব নাম করণ করা হয়েছে। কালোর সাথে যে কত বিচিত্র সব উৎস থেকে শব্দ জুড়ে দেওয়া গয়েছে তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়। কালো বকরি, কালা কচু, কালা সোনা, কালামানিক, কালা বোয়ালি, কালা ষাইট্টা, কালো পাহাড়, কালো চিনা, কালো কুমারি এমনি সব কালো বর্ণের দানা বিশিষ্ট ধানের জাত। অন্য বর্ণের নাম দিয়েও ধানের কত নাম রাখা হয়েছে। সাদা কলম, সাদা আমন, লাল আউশ, সিঁদুর কোটা, দুধ শাইল, ধলা সাইট্টা, দুধসর কিংবা কৃষ্ণজিরা ধানের এক একটি জাতের নাম।
নদীর নাম জুড়ে নাম পেয়েছে যেসব ধান জাত সেগুলো হলো গঙ্গা সাগর, মধুমতি ইত্যাদি। কোন মাসে ধান পাকে তার উপর ভিত্তি করেও হয়েছে কোনো কোনো জাতের নাম আশ্বিণা, কার্তিক দুল, কার্তিক শাইল, আশ্বিনীকান্দি, অশ্বিনিনা, বৈশাখী, চৈতা ইত্যাদি। সুগন্ধি পোলাও ধানের বড় বাহারি এক একটি নাম। কার ভোগে লাগে এসব ধান সে ইঙ্গিত দিয়ে নামকরণ হয়েছে অনেকের ঠাকুরভোগ, দয়ালভোগ, বাদশাভোগ, সুলতানভোগ, সবরিভোগ, গোপালভোগ, রাজভোগ, রাজভোগশাহী, গোবিন্দভোগ, রসুলভোগ, সীতাভোগ, ইত্যাদি। ঠাকুর, সীতা, গোপাল বা গোবিন্দকে যে আনন্দের সাথে ভক্ত নিবেদন করতে পারে সে যে উত্তম চালের ভোগ তা সহজেই অনুমান করা চলে। তাছাড়া রসুলের জন্য যে ভোগ সে বিশেষ রকম সুগন্ধী চাল দিয়ে তৈরি হতে পারে বলে এর নাম হয়েছে রসুলভোগ; সেটি মোটেই অবাক হওয়ার নয়। এমনকি রাজাকে, সুলতানকে পরিবেশন করা যায় তেমন পোলাও চাল পাওয়া যায় যে ধান থেকে তার নাম রাজভোগ বা সুলতান ভোগ হবে সেটাইতো স্বভাবিক। ভোগ ছাড়াও অন্য নামকরনের মাধ্যমেও সুগন্ধী ধানের গুণকীর্তন প্রকাশিত হয়েছে নামের মধ্যেই। রাধুনি পাগল, বৌসোহাগী, জামাই নাড়–, বৌপাগলা নামের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট। পোলাও রাঁধতে গিয়ে রাঁধুনী যখন গন্ধে আকুল হয় তখন সে জাতের নাম রাধুনি পাগল ছাড়া আর কী হবে। নামের মধ্য দিয়েই গুণের এক আশ্চর্য প্রকাশ। অতি প্রিয় ধানজাতগুলোর মধ্যে কত চমৎকার সব নাম দিয়েছে আমাদের পূর্ব পুরুষরা। লক্ষèীলতা, দুলাল, লক্ষèী বিলাস, দুধসাগর, সোহাগ, কাঁচা ননি, দুধসর ও চন্দ্রহার নামের মাধ্যমেই এর প্রকাশ।
ধানী মৌসুমের নাম জুড়ে দিয়েও হয়েছে কোনো কোনো জাতের নাম। সোনালী বোরো, কালিবোরো, চন্দন বোরো, শাইল বোরো, টেপি বোরো, জংলী বোরো, খৈয়া বোরো, লাল বোরো ইত্যাদি নামের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় এদের আবাদ করা হয় বোরো মৌসুমে। শাইল ধান বলা হয় বোনা আমন ধানকে। বহু সংখ্যক ধানের জাত রয়েছে যাদের নামের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘শাইল’ শব্দটি রোপা আমন ধানের জাত যে এগুলো নামের মধ্য দিয়েই প্রকশ পেয়েছে। তেমনি কিছু শাইল ধান হলো আগুন শাইল, শওকত শাইল, জাবর শাইল, লোনা শাইল, বাঁশ শাইল, মেদি শাইল, মাধব শাইল, কাচি শাইল, এনা শাইল, গুয়া শাইল, কার্তিক শাইল, মধুশাইল, কামিনী শাইল, রাই শাইল, আমশা শাইল, জিংগা শাইল, পানি শাইল, ভূট্টা শাইল, পুটি শাইল, ইঁদুর শাইল, কাইদ শাইল, গাবরা শাইল, আনি শাইল, মুকুট শাইল, মাগুর শাইল, পশু শাইল, চুল শাইল, দারকা শাইল, ভোতরা শাইল, শনি শাইল, সোনা শাইল, ঢেঁকি শাইল, ভাসা শাইল, শুং শাইল, ঝুপরি শাইল, বোঁটা শাইল, আশানি শাইল, বিহারী শাইল, রঘু শাইল, মানিক শাইল, মাধব শাইল, কলমী শাইল, কচু শাইল, নিদান শাইল, লাম শাইল, দয়া শাইল, কদম শাইল, পিপরা শাইল, বুচা শাইল, ডাকিয়া শাইল, লোরা শাইল, বোটা শাইল, দাইদ শাইল, আম শাইল, ঝিংগা শাইল, কালা শাইল, আতা শাইল, ভবানী শাইল, নোয়া শাইল, ওকরা শাইল, কুমড়া শাইল, গরুয়া শাইল, টেপী শাইল, আতব শাইল, বৈরাগী শাইল ও গন্ধি শাইল।
বিন্নি ধানের খৈ বাংলাদেশের লোকজ উৎসবের এক আবশ্যিক অনুষঙ্গ। বিন্নি ধানের খৈ আর বাতাসা ছাড়া কোনো মেলা পার্বণ এ দেশে হয়নি।। সেই বিন্নি ধানও যে নানা রকমের রয়েছে তা আর কয়জনই বা আমরা জানি। চন্দন বিন্নি, মধু বিন্নি, খরা বিন্নি, বাংলা বিন্নি তেমনি সব কত রকম বিন্নি রয়েছে আমাদের। খৈ তৈরির জন্য ব্যবহৃত কোনো কোনো দেশি জাতের নামে রয়েছে খৈ শব্দটি। খই, খইয়া তেমনি সব দেশি জাতের ধান। কোনো কোনো দেশি ধানের জাতের নাম এত চমৎকার যে বারবার এদের নাম উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করে। হয়তো এদের অধিকাংশই আজ আর কৃষকের মাঠে নেই, তবুও এদের নামগুলো উচ্চারণের মধ্য দিয়ে এক আশ্চর্য আবেগ আর হৃদয় ছোঁয়া অনুভূতি জেগে ওঠে। মধুমালা, জলকুমারী, ঝরাবাদল, মধুমালতি, কনকচূড়, আয়না মহল, চাঁদমনি, ময়ুর কন্ঠি, হাসিকলমী এসব নামের মধ্য দিয়ে যে আবেগময় মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর মেলে তা অন্য কোনো ফসলের জাতের নেই।
বীজের আকার ছোট বলে ধানের নাম হয়েছে বেগুনবিচি, ক্ষুদে বরণ। সরু বীজ যাদের তাদের কোনো কোনোটার নাম সরু ধান বা চিকন। সরু বা চিকন চালের ধানের আরও নাম রাখা হয়েছে লাল চিকন, বাদাই চিকন, চিকন ধান, সাদা চিকন। অনুমান করি বড় বড় বীজ থাকায় হয়তো কোনো কোনো জাতের নাম বাইশ মনি, চৌদ্দমুগুর। জাতির নাম জুড়ে দিয়েও রাখা হয়েছে কোনো কোনো ধানের জাতের। বাঙালি, ফরাসি, বাঙালানি, তুর্কি ধান জাতির নামের সাথে মিল রেখে রাখা নাম। মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন এমন নামও রয়েছে অনেক জাতের। সরষে বানর, আল্রা বক্সি, চার্নক, ডেপর, কারাইল, লেজা, গর্চা, ভাষা, খাবলি ইত্যাদি নাম এর কিছু উদাহরণ। কোনো কোনো জাতের নমে একটি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাবও আপতত মনে হয়। শনি, সরশে বানর, বাঙালদাড়ি, পশু এ রকম ধানের নাম কোন কারণে রাখা হয়েছে তা আজও অনুমান করা শক্ত। নাম দেখে মনে হয়, এদের গুণের পাল্লা একবারেই হালকা। কোনো কোনো ধানের নাম চালাকি বা চপল বা বলদা কিংবা মুসলিম কেন তা রীতিমতো ভাবার বিষয়। কোনো কোনো ধানের নাম কেনবা ‘গোরা’ বা ‘গম্ভীরা’ কিংবা ‘সাধু’ সেটিও কম ভাবনার বিষয় নয়। কোনো বিচিত্র ভাবনা আর ধানের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখে এসব নামকরণ করা হয়েছে তা আজ জানা অনেক ক্ষেত্রেই প্রায় অসম্ভব। কোনো বিশেষ মাদকতা ছিল কিনা ‘গাজা’ জাতটির বোঝার আজ উপায় নেই। কি গুণের কারণে ধানের নামকরণ হয়েছিল বৈরাগী বা খেয়ালী সেটি আজ রীতিমত গবেষণার বিষয়। পাগলী নামের ধান জাতটি যে কৃষকের বাড়তি আবেগ পেয়ে এ নামটি পেয়েছে সেটি ধারণা করা চলে। তবে বৌ পালানী নামটি নিয়ে ধান জাতটির মন্দ স্বভাবেরই ইঙ্গিত বহন করা হয়েছে বলে মনে হয়।
বোনা আমন ধান যে পানিতে জন্মায় কোনো কোনো জাতের মধ্য দিয়ে রয়েছে তার সহজ প্রকাশ। জল, জালি, পানিশাইল, সোনা, মলি, জল বা পানি শব্দ সহযোগে এদের জলজ স্বভাবের বিষয়টিই উঠে এসেছে। পানিতে জন্মায় এ কথা বোঝাতে ‘দিঘা’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে অনেকগুলো গভীর পানির ধান বা জলী ধানের। লক্ষèী দিঘা, মানিকদিঘা, রাজা দিঘা, লতা দিঘা, হিজল দিঘা, ধলা দিঘা, আশ্বিনা দিঘা, এভাবেই দিঘা যুক্ত নাম প্রাপ্ত হয়েছে। এলাকা ভিত্তিক একই জাতের যে কিছুটা ভিন্ন নামও ছিল সে উদাহরণও রয়েছে। নামের কিছুটা ভিন্নতা সত্বেও এরা আসলে একই জাত নামগুলোা নিয়ে একটু ভাবলে তা বেশস্পষ্ট হয়ে ওঠে। একই জাতের ভিন্ন নামের উদাহরণ হলো লোনাশাইল/নোনা শাইল, রাধুনি পাগল/রান্ধুনি পাগল, নারিকেল বেদী/নারিকেলপদী, চিনিগুড়ী/চিনিগুড়া, বৌপাগলা/বৌপাগল, মাটিচক/মতিচক, কৈয়াঝুড়ি/কৈঝুরি ইত্যাদি
দেশি জাতের ধান দেশের মানুষের কতটা মন জুড়ে ছিল তার কিছু নমুনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের নানা রকম লেখায়। এসব লেখা পড়েও জানা যায় ধানের নাম বৈচিত্র্যের ব্যাপ্তি। কালিদাস থেকে শুরু করে এই আধুনিক কাল পর্যন্ত অনেক লেখক কবি তাদের লেখায় এসব ধানের জাতের প্রশংসা করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ধানের নাম পাওয়া গেছে অনেক। শূন্যপূরাণ নামক গ্রন্থে আশিটি ধানের নাম মিলেছে। বর্ণানুক্রমে সেগুলো হল আজান, আন্ধারকুলি, আমপাবন, আমলো, আলোচিত, আসঅঙ্গ, আসতির, উড়াসালী, ককাচি, কনকচুর, কাঙদা, কামদা, কালাকাত্তিক, কালাযুগর, কুসুমমালী, কোটা, খীরকম্বা, খেজুরছড়ি, খেমরাজ, গআবালী, গন্ধতুলসী, গন্ধমালতী, গুজুরা, গোতমপলাল, গোপালভোগ, চন্দনসালি, ছিছরা, জলারাঙ্গি, জেঠ, জোলি, ঝিঙ্গাসাল, টাঙ্গন, তসরা, তিলসাগরি, তুলসানি, তুলানধান, তোজনা, দলাগুরি,দাড়, দুধরাজ, নাগরজুগান, পর্বতজিরা, পলাল, পাঙ্গুসিয়া, পাতন, পাথরা, ফেফেরি, বককড়ি, বন্ধি, বাঁকই, বাঁকচুর, বাঁকসাল, বাঁজগজা, বাঁসমতী, বাগনবিচি, বালি, বিন্ধসালী, বুখি, বুড়ামত্তা, বোআলী, ভজনা, ভাদোলী, ভাদ্দমুখি, মইপাল, মাধবলতা, মুক্তাহার, মুলা-মুক্তাহার, মৌকলস, লতাকো, লাউসলী, লালকামিনি, সনাখড়কি, সালছাটি, সীতাশালী, সোলপনা, হরি, হরিকালি, হাতিপাঞ্জর ও হুকুলী
তেমনি মধ্যযুগের আর একটি গ্রন্থ হলো‘ শিবায়ন’। শিবায়নে উল্লেখ রয়েছে অনেকগুলো ধানের নাম। শূূণ্যপূরাণ ও শিবায়ণ দুটি গ্রন্থেই একই ধান জাতের নাম থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন ধানের নামও রয়েছে অনেক। ‘শিবায়ণ’ গ্রন্থে উল্লিখিত ধানের নামগুলি হলো কটকী, কনকচুর, কনকলতা, কলমীলতা, কপোতকন্ঠিকা, কয়াকচ্চা, কামোদ, কার্তিকা, কালিন্দী, কালিয়া, কাশীফুল, কুমুুমশালী, কৃষ্ণশালী, কেলেকানু, কেলেজিরা, কোঙরভোগ, কোঙরপূর্ণিমা, ক্ষেম, খয়েরশালি, ভেজুর-থুপী, গঙ্গাজল, গন্ধমালতী, গয়াবলি, গুণাকর, গুয়াথুপি, গোপালভোগ, গৌরিকাজল, চন্দনশালি, চামরঢালি, ছত্রশালি, ছিঙ্গাশালি, জগন্নাথভোগ, জটাশালি, জলারাঙ্গী, জামাইলাডু, তিলসাগরী, দাড়বঙ্গী, দুধরাজ, ধুল্যা, ধুস্তুর, নছীপ্রিয়, নন্দনশালি, নিমই, পর্দেশী, পাতলাভোগ, পয়রারস, পিপীড়াবাঁক, পূণ্যবতী, বলাইভোগ, বাকচুর, বাঁকশালি, বাকোই, বুড়ামাত্রা, বুয়ালী, ভবানীভোগ, ভোজন, রঙ্গয়কড়ি, রাঙ্গামেট্যা, রাঙ্গী, রামগড়, রামশালি, লক্ষীকাজল, লাউশালি, শঙ্করজটা, শঙ্করশালি, সীতাশালি, হরকুলি, হরিশঙ্কর, হলুদগুড়া, হাতিপাঞ্জর, হাতিপাদ, হিঞ্চি ও হুড়া।
একালে এসেও ধানের কথা ঘুরে ফিরে এসেছে আমাদের সাহিত্যে নানভাবে, নানা প্রসঙ্গে। করি ফররুখ আহমেদ ধানের বিচিত্র সব জাতের মহিমায় এতটাই বিমুগ্ধ ছিলেন যে, তাঁর একটি কবিতার নামই ছিল‘ ধানের কবিতা’।‘ মুহুর্তের কবিতা’ নামক গ্রন্থে এ কবিতাটি স্থান পেয়েছে। আমাদের এক সময়ের অতি জনপ্রিয় জাতগুলো কবির কবিতায় কিভাবে ধরা পড়েছে কবিতাটি না পড়লে বোঝা যাবে না। কবিতাটির প্রথম আট লাইন হলো:
কুমারী, কনকতারা, সূর্যমুখী, হাসিকলমী আর
আটলাই, পাশলাই ধান-এ পাক বাংলার মাঠে মাঠে।
আউষ ধানের স্বপ্নে কিষাণের তপ্ত দিন কাটে;
আমনের বন্যা আনে ফসলের সম্পূর্ণ জোয়ার।
শোকর গোজারী ক’রে তারপর দরবারে খোদার
গোলায় তোলে সে ধান-রূপসা’ল তিলক কাচারী,
বালাম, ক্ষীরাইজালি, দুধসর-মাঠের ঝিয়ারী
কৃষাণ পল্লীতে আনে পরিপূর্ণ মুখের সম্ভার।
হাজার হাজার দেশি ধানের জাত আজ বিদায় নিয়েছে কৃষকের মাঠ থেকে। এদের অনেকেই বিলুপ্ত হয়েছে চিরদিনের জন্য। অনেককেই সংরক্ষণ করা হয়েছে জিন ব্যাংকের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এখনও যেসব দেশি ধানের জাত আবাদ করা হয় তা হচ্ছে মূলত দেশের নির্দিষ্ট কিছু নিচু অঞ্চলে। বহু ধান জাতের নাম বিস্মৃত হয়েছেন এদেশের কৃষকরা। আমাদের মন থেকেও মুছে গেছে অনেক ধানের নাম। দিনে দিনে মুছে যাবে এসব বাহারি ধানের নাম। এ কথা ভাবতে মন কিছুতেই সায় দেয় না বটে কিন্তু বাস্তবতা তো আমাদের সে দিকেই নিয়ে যাচ্ছ। প্রয়োজন আমাদের আবেগকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে। তবু জিন ব্যাংকে যাদের সংরক্ষণ করা হয়েছে এদের জিন আমাদের আধুনিক ফসলে সংযোজন করে দিয়ে হয়তো কাঙ্খিত ফল লাভ করা সম্ভব হবে। জিন ব্যাংকে আজও যাদের সংরক্ষণ করা হয়নি তাদের সংরক্ষণ করতে হবে আমাদের প্রয়োজনেই। মাঠ থেকে হারালেও গবেষণার প্রয়োজনে যেন একবারে যেন বিলুপ্ত না হয়ে যায় সেটিও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।