সাম্প্রতিক পোস্ট

লৌহের কারিগরদের দিনকাল

নেত্রকোনা থেকে মো. আব্দুর রব

“আমি মইরা যাওয়ার সাথে সাথে এই পেশার বিলুপ্তি হবে। বাবার কাছে শিইখ্যা আমি করতাছি। আমি মইরা গেলে সব শেষ। আমার ছেলেরা করতোনা। তারা অন্য কাম করে, পড়ালেখা করে এই পেশায় আইতোনা”। হতাশা ভরা কণ্ঠে এই কথাগুলো বলছিলেন হরিদাস চন্দ্র রায়। নেত্রকোণার সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের একটি গ্রাম বাইশদার। এই গ্রামেই বাস করেন হরিদাস চন্দ্র রায়, যিনি কর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষ। এই সম্প্রদায় ছাড়াও সূত্রধর, শীল, মাঝি এবং কুলুূ সম্প্রদায়ের মানুষও এ গ্রামে বাস করেন। এসব জনগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ভিত্তিক পেশা রয়েছে, যা তাঁরা স্মরণাতীত কাল থেকে অনুশীলন করে আসছেন। তবে আধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাব, এ পেশায় লাভ কমসহ নানা কারণে সম্প্রদায়ভিত্কি এই ঐতিহ্যবাহী পেশাগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। এই গ্রামের কর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষেরা লৌহ কারিগরির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে এই পেশার অতীত জৌলুস হারিয়েছে বলে জানান হরিদাস চন্দ্র রায়।

Kar
এই গ্রামের বাসিন্দাদের সাথে প্রাথমিক আলোচনায় জানা যায়, একসময় এখানে অনেক লোকের বসবাস ছিল। কারও কোন পারিবারিক বা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হতো। তবে বর্তমানে উপরোক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে দু-একটি ছাড়া আর কোন সম্প্রদায়কে দেখা যায় না। কেননা তাদের অনেকের পেশাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। টিকে আছে শুধুমাত্র কর্মকার সম্প্রদায়। এই গ্রামে এখনও ৬টি কর্মকার সম্প্রদায়ের পরিবার রয়েছে। তারা এখনও বাপ-দাদার আমলের ঐতিহ্যবাহী পেশা টিকিয়ে রাখার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধি হরিদাস চন্দ্র রায়। পঞ্চাশোর্ধ বয়সের এই মানুষটি এখনো হাঁপরের সাহায্যে লোহা দিয়ে যাবতীয় উপকরণ তৈরি করেন।
বাবা সনদ কুমার রায়ের কাছেই তার হাতেখড়ি হয় বলে তিনি জানান। ছোটবেলা থেকেই বাবার কাজে সাহায্য করতে গিয়ে তিনি লোহার শিখেছেন। তিনি বলেন, “এই কাজ হাতে ধইরা শিখায়া দিতে অয়না, সমস্তডাই চোখের আন্তাজ।” তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭ জন। বড় দু’টি ছেলে  লেখাপড়া খুব বেশি না করলেও এই কাজ করতে আগ্রহী নয়। সোনা রূপার দোকানে কাজ করে। আর ছোট ছেলে ২০১৬ সালে এসএসসি পরিক্ষায় পাস করেছে।

কর্মকারদের ঐতিহ্যবাহী পেশা হারিয়ে যাওয়ার নেপথ্য কারণ বলতে গিয়ে হরিদাস চন্দ্র রায় বলেন, “বর্তমানের সব কিছুই উন্নতির দিকে। সময় বদলাইতাছে, সমাজের পরিবর্তন অইতাছে। একজনের দেখাদেখি অন্যজনও পড়া লেখা শুরু করে। তারা পড়ালেখা শেষ কইরা কেউ চাকুরি বা ব্যবসা করে। বিভিন্ন শহরে গিয়া অন্যের দোকানেও কাজ করে। সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়। যে কারণে কেউ আর নিজ গ্রামে ফিইরা আসেনা। আর বাপ দাদার পুরানো কাজ ও কেউ করতে চায় না”। শুধু হরিদাস চন্দ্র রায়ই নয়, এই গ্রামের বাকী ৫টি পরিবারের চিত্রও একই। তাদের ছেলেরাও পড়ালেখা করে আজ শহরে প্রতিষ্ঠিত। পরিবার প্রধানদের মৃত্যুর পর এই গ্রামে কেউ আর এই পেশা চর্চা করবে না।
অথচ একসময় এই গ্রামের কর্মকারদের কাছ থেকে নেত্রকোণা সদর, আটপাড়া, মদন, কেন্দুয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের লোকজন এসে নিজেদের প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরি করে নিয়ে যেতো। এখনো অনেকেই আসে, তবে খুব কম। কারণ নানান জায়গায় দোকান বা অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের কাছ থেকেই বর্তমানে এগুলো তারা সংগ্রহ করতে পারেন। আগে শুধুমাত্র এই সম্প্রদায়ের লোকজন কোথায় থাকেন, তা খোঁজ করে তাদের কাছ থেকেই জিনিস বানিয়ে বা তৈরি করে নিত মানুষজন।

kar-3
কয়লায় আগুন জ্বালিয়ে হাঁপরের সাহায্যে যে সব জিনিসপত্র তৈরি করতো এই সম্প্রদায়ের মানুষ সেগুলো হলো দা, কুড়াল, ছেনি, শাবল, কাচি, খুনতি, ছুড়ি, বটি, কুদাল, নরুন ইত্যাদি। সারাবছরের তুলনায় ধান কাটার মৌসুমে কাজের চাপ একটু বেশি থাকে। তখন তারা কাঁচি তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটায়। কিন্তু অন্যান্য সময় বাকি জিনিসগুলো ফরমায়েশ মতো তৈরি করে দেয়। এই জিনিসগুলো তৈরিতে তাদের যে সমস্ত উপকরণ লাগে তারা সেগুলো নিজেরা বানিয়ে নেয়। যেমন, আইতনা (হাঁপর), হাতুড়ি, রেত, টানা, চোঙ্গা। শুধুমাত্র কয়লা ও লোহা তারা কিনে আনেন।

বর্তমানে বৈদ্যুতিক মেশিনের সাহায্যেও লোহার কাজ করা যায়। কিন্তু তাতে খরচ বেশি। অন্য অসুবিধাও আছে। হরিদাস বলেন, “এই মেশিনের কোন দাঁড়ি, কমা নাই। আফনে যে নেত্রকোণা যাইতাছুইন, যাইতেই আছুইন। থামাথামি নাই। আমার যন্ত্র দিয়া আমি সুবিধা মতো কাজ করি। আগুনের তাপ কমাইতে পারি আবার বাড়াইতেও পারি”।
্এসব জিনিসপত্র তৈরি করে যা আয় তা দিয়ে সংসার চালান হরিদাস। তবে এই পেশা আগের মতো কোন আয় নেই বিধায় তাদের নতুন প্রজন্ম এই পেশায় আসতে চায় না। সঙ্গত কারণেই এই ঐতিহ্যবাহী পেশা আজ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।

happy wheels 2

Comments