একজন রিক্সা চালকের মহানুভবতা
দুর্গাপুর, নেত্রকোনা থেকে তোবারক হোসেন খোকন
স্বপ্ন সবাই দেখে তবে খুব কম মানুষই তাঁর স্বপ্নকে পূরণ করতে পারে। পড়াশোনা করে প্রতিটি শিক্ষার্থী নিদির্ষ্ট একটি স্বপ্ন তাড়া করে। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজন অধ্যবসায়, প্রত্যয় ও উদ্যম। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। সবাই স্বপ্ন দেখে মানুষকে সেবা করার, নিজের উন্নতি করার এবং সাফল্যে শিখরে পৌছানোর। অনেকে তাদের কাঙ্খিত স্বপ্নে পৌছে যান আবার অনেকে পৌছাতে পারেন না। স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার তালিকাদের মধ্যে যুক্ত হয়েছে তেমনই একজন যুবক যার নাম তারা মিয়া। তারা মিয়া স্বপ্ন দেখতেন লেখাপড়া করে নিজের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নের পাশাপাশি মানবতার সেবা করার। কিন্তু দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়ায় তাঁর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে তাকে বইতে হয়েছে সংসারের বোঝা। তাঁরা মিয়ার বাড়ি দুর্গাপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নে। দিনমজুর মো. হেলিম ও গৃহিনী রহিমা খাতুন এর ছেলে তারা মিয়া। তারা মিয়া নিজে বিবাহিত এবং তাঁর একটি ৭ বছরের এক ছেলে আছে। নিজেকে লেখাপড়া করতে না পারলেও তাঁরা মিয়া স্বপ্ন দেখেন যারা লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি তাদের সহযোগিতা করার। এজন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করছেন। তাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতে নিতে হয়েছে রিক্সার হ্যান্ডেল। গত এক বছর পূর্বেও তিনি রিক্সা ভাড়ায় চালাতেন। বর্তমানে তিনি নিজে ব্যাটারি চালিত রিক্সা কিনে চালান। প্রতিদিনই আয় থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে রাখেন তাঁর স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য।
তাঁরা মিয়া জানান, দরিদ্রতার কারণে তারা তিন ভাই পড়ালেখা করতে পারেননি। তবে নিজে লেখাপড়া করতে না পারলেও যাতে অন্যরা সেটা থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য তিনি দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই ইচ্ছা ও স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য তিনি প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করেন। রিক্সা নিয়ে ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন জায়গায়। কিছু সঞ্চয় করার তাগিদ থেকে তিনি দুপুরে ভাত না খেয়ে প্রায় ৬ মাস যাবৎ টাকা পয়সা সঞ্চয় করেন। এই টাকা দিয়েই তিনি গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ কেনেন। সামর্থ্য অনুযায়ী তিনি বিভিন্ন সময়ে বারমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১০ জন ছেলে মেয়েকে খাতা কলম, নলুয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০ জনকে খাতা, ৭ জন প্রতিবন্ধী শিশুকে টিফিন বক্স, চকলেংগুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪০টি খাতা-কলম, দেবথৈল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০ জন আদিবাসী শিশুকে খাতা কিনে দিয়েছেন। এসব শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্য তারা মিয়া প্রতিদিন তাঁর নিজের ঘরে একটি মাটির ব্যাংকে ১০ থেকে ১৫ টাকা করে জমা করে রাখেন। প্রতিমাস শেষে যে টাকা হয় তাই দিয়ে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেমেদের এ সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এসব দরিদ্র ও মেধাবী ছেলেমেয়েদের সাথে তার রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাদেরকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করছেন। তিনি নিজে পড়ালেখার সুযোগ পাননি। পড়ালেখার সুযোগ না পাওয়ার কষ্ট তাকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়েছে। এই কষ্ট যাতে অন্যদের করতে না হয় সেজন্য তিনি এমন কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজে আলোকিত মানুষ তৈরির জন্য তাই তিনি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টাটিই করে যাচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে তারা মিয়া বলেন, ‘‘আমরার এই সমাজো যারা ধনি ব্যাডাইন আছোইন, হ্যারা যদি একটু কইরা সাহায্য করইন, তইলেই তো আমরার দ্যাশটা সোনার বাংলা অইবো।’’
ছোট্ট একটি পেশা থেকেই নিরক্ষর তারা মিয়া যদি সমাজ বিনির্মাণে ভাবিত হতে পারেন তাহলে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন আমরা কি একটু ভাবতে পারি না? আমাদের সমাজে এখনো রয়েছে অভাব অনটন। দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থাকে শক্তিশালী করতে শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষাটাকে উন্নত করতে হবে। নজর দিতে হবে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে। যাতে করে কোন শিক্ষার্থী দারিদ্রতার কারণে স্কুল থেকে ঝরে না পড়ে। তারা মিয়া চাননি তার মতো করে কোন ছেলে বা মেয়ে অল্প বয়সে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। তিনি চাননি কোন ছেলে বা মেয়ে দারিদ্রতার কাছে পরাজিত হয়ে আলোর পথ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করুন। চাননি বলেই এত কষ্টের মধ্যেও তিনি এতগুলো ছেলেমেয়েকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। নিজে খেয়ে না খেয়ে এসব কোমলমতি শিশুদেরকে আলোকিত করার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাই প্রশ্ন উদয় হয়, এটা শুধু রিক্সা চালক তারা মিয়া ভাববেন? আমরা কি একটু ভাবতে পারি না? দরিদ্র ও নিরক্ষর তারা মিয়ার চেয়ে আমরা তো আরও বেশি সামর্থ্য রাখি। তাহলে কি আমরাও কি উদ্যোগ নিতে পারি না? তাই আসুন সোনার বাংলা গড়তে তারা মিয়ার পাশাপাশি আমরাও এগিয়ে আসি। আর কোন ছেলে মেয়েকেই শিক্ষা থেকে ঝরে পড়তে দেবেনা এই প্রতিজজ্ঞা করি।