মোহরে “স্বপ্ন আশার আলো” এর নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম গড়ার অভিযান
:: রাজশাহী থেকে রাজু আহমেদ বাপ্পী
শিক্ষার যে কোন বয়স নেই সেটি আবারও প্রমাণ করলেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার মোহর গ্রামের ৭০ জন নারী ও পুরুষ। মোহর গ্রামের স্বপ্ন আশার আলো যুব সংগঠনের উদ্যোগে এবং বারসিকের সহযোগিতায় গত ৪ মাস ধরে চলছে মোহর গ্রামকে নিরক্ষরমুক্ত করার মহৎ কাজ। যদিও হাতে কলমে স্বাক্ষরতা শেখানোর কাজটি ৪ মাসে আগে শুরু হয়েছে কিন্তু এর মূল কাজটি শুরু হয়েছিল তারও কয়েক মাস আগে। স্বপ্ন আশার আলো যুব সংগঠনটি প্রাথমিক পর্যায়ে একটি জরিপ দিয়ে তাঁদের কাজটি শুরু করে। সংগঠনের সদস্যরা তাঁদের গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে একটি জরিপ চালান এবং ৮০ জন মানুষকে চিহ্নিত করেন যাঁরা স্বাক্ষর প্রদান করতে পারেন না বা যাঁদের মধ্যে অক্ষর জ্ঞান নেই। প্রাথমিক জরিপ শেষে তাঁরা জরিপকৃত মানুষগুলোর সাথে আলোচনা করেন এবং তাঁদের কাছে জানতে চান যে, সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য যদি স্বাক্ষর শেখানোর ব্যবস্থা করা হয় তাহলে তাঁরা শিখতে রাজি কি না। অধিকাংশ মানুষই শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। স্বপ্ন আশার আলোর সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে বারসিকের সাথে আলোচনা করেন এবং বারসিক তাঁদেরকে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করে।
যুবকরা এরপর পাড়াভিত্তিক ৪টি ইউনিট গঠন করেন এবং ৪ জনকে ৪টি ইউনিটের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যার মধ্যে দু’টি ইউনিট পরিচালনা করেন নারীরা। প্রতিটি ইউনিটে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। কোন ইউনিটে শুধু নারীরা আছেন আবার কোন ইউনিটে নারী পুরুষ উভয়ে রয়েছেন। প্রতিটি ইউনিটের পাঠদানের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের মতামত অনুযায়ী। কারো বাড়ির কাজের যেন কোন ব্যঘাত না ঘটে সেদিকটাও লক্ষ্য করা হয় সময় নির্ধারণে। কোন ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয় দুপুর ২টায়, কোন ইউনিটের বিকাল ৫ টায় আবার কোনটির সন্ধ্যার পর। এই কার্যক্রমে ৩০ বছর বয়সের মানুষ যেমন আছেন তেমনি আছেন ৬০ বছর বয়সের মানুষও। এই কর্মসূচির আওতায় প্রত্যেককে একটি করে বই, খাতা এবং কলম দেওয়া হয়েছে এবং পাশাপাশি প্রতিটি ইউনিটে একটি করে ব্ল্যাকবোর্ড ও লেখার জন্য চক দেওয়া হয়েছে। ৪টি ইউনিটের মধ্যে ৩টি ইউনিট চলে গ্রামের বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর একটি চলে গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে। আদিবাসী ইউনিটের দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁদের সম্প্রদায়েরই একজন মানুষ।
স্বাক্ষরতার এই কার্যক্রমটি যদিও স্বপ্ন আশার আলো যুব সংগঠন পরিচালনা করছে। কিন্তু এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ৪টি ইউনিটের মধ্যে ৩টি ইউনিটই এমন কয়েকজন মানুষ পরিচালনা করছেন যাঁরা এই সংগঠনের কোন সদস্য না। নিজেদের সদস্যদের বাইরে অন্যদের দায়িত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্য হল, কাজটি যেন শুধুমাত্র তাঁদের সংগঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে সবার মাঝে ছড়িয়ে যায়। তাছাড়া, তাঁরা এমন কিছু মানুষকে দায়িত্ব দিয়েছেন যাঁরা অক্ষর শিখতে আসা মুনুষগুলোর পরিচিত বা তাঁদেরই পাড়ার, যেন তাঁদেরকে গ্রহণ করতে কোন সমস্যা না হয় বা শিখতে লজ্জা না করে। তাঁরা সংগঠনের কোন সদস্যও না আবার এটি থেকে তাঁরা আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও তাঁরা কেন এই কাজের সাথে নিজেদের যুক্ত করেছেন সেই প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বলেন, “আমরা মূলত সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এবং নিজেদের ভালো লাগা থেকে কাজটি করছি।” এই প্রসঙ্গে রোজিনা আক্তার, যিনি নারীদের একটি ইউনিট পরিচালনা করেন বলেন, “আমি যখন কোন জায়গাই স্বাক্ষর প্রদান করি এবং যখন দেখি যে, পাশের মানুষটি স্বাক্ষর প্রদান করতে পারছেন না তখন আমার খারাপ লাগে, আমার মনে হয় আমি যদি পারি তাহলে এই মানুষটি পারবে না কেন? কিন্তু আমার কিছু করার থাকে না। তাই এখন যখন এই ধরনের একটি সুযোগ পেলাম তখন আর হাতছাড়া করলাম না।”
এই কাজটি করতে গিয়ে ইউনিট পরিচালনাকারীরা এখন পর্যন্ত কোন বাধার সন্মূখীন হয়নি বলে তাঁরা জানান। নারী এবং পুরুষের মিশ্র ইউনিট পরিচালনাকারী বলেন, “আমার ইউনিটটি আমার বাড়িতে পারিচালিত হয়। ফলে আমার স্বামী ঐ সময় বাড়িতে থাকলে আমাকে সাহায্য করে। বিশেষ করে যখন আমার কোন কাজ থাকে তখন তিনি আমার পরিবর্তে ক্লাস নেন এবং আমার ছোট মেয়েটিও তাঁদের সাথে ক্লাস করে।”
যে মানুষগুলো এখানে স্বাক্ষরতা শিখছেন তাঁরা বেশ স্বাচ্ছন্দেই পাঠ গ্রহণ করছেন। স্বাক্ষরতা শিখছেন এমন কিছু মানুষের অভিজ্ঞতা ও অনুভুতি জানতে চাওয়া হলে মোসা: শেফালি বেগম (৪৮) বলেন, “আগে তো আমি কিছুই জানতাম না, এখন একটু একটু পড়তে পারি আশা করি ডিসেম্বরের মধ্যেই আরো ভালোভাবে পড়তে ও লিখতে পারবো। কয়েক দিন আগে আমি প্রথম কিস্তর বইয়ে স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু এর আগে কখনো তা করতে পারিনি।” লাইলি বেগম (৪০) বলেন, “আমি এ কার্যক্রমের সাথে শুরু থেকেই আছি এবং এখান থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমি এখানে আসার আগে কোন স্বাক্ষর করতে পারতাম না, কোন জায়গাই স্বাক্ষর দেওয়ার প্রয়োজন হলে টিপ সই দিতাম। ফলে অনেক সময় আমাকে কথা শুনতে হতো, যা আমাকে লজ্জাই ফেলে দিত।” রাহিমা বেগম (৩২) বলেন, “আমার মেয়ের উপ-বৃত্তির জন্য অভিভাবকের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। এতো দিন আমি সেখানে টিপসই দিয়ে এসেছি কিন্তু এইবারই প্রথম আমি নিজ হাতে স্বাক্ষর করতে সমর্থ হয়েছি।”
এই মানুষগুলো সবাই এখন অক্ষর চেনা ও স্বাক্ষর করতে পারায় মানুষের সামনে তাঁদেরকে অপমানিত হতে হয় না। এতো বছর পরে এসে পাঠ গ্রহণ করতে তাঁদের কোন সমস্যা, কুণ্ঠা বা সংকোচ হয়নি বলে তাঁরা জানান।
স্বপ্ন আশার আলো বর্তমানে ৪টি ইউনিটে বিভক্ত হয়ে এই কার্যক্রমটি চালাচ্ছে এবং আরো একটি ইউনিট গঠন করার প্রক্রিয়া চলছে। স্বপ্ন আশার আলো আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের ৪টি ইউনিটের কার্যক্রমের প্রথম ধাপ সম্পন্ন করতে পারবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। স্বপ্ন আশার আলোর এই কার্যক্রম সম্পর্কে তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানেন এবং সবসময় এই কাজের প্রশংসা করেছেন। এই কাজকে আরো কার্যকরী ও বেগবান করার জন্য ইতিমধ্যেই তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বয়ষ্ক শিক্ষার বইয়ের জন্য সুপারিশ করেছেন বলে তাঁরা জানিয়েছেন। স্বপ্ন আশার আলোর রবিউল ইসলাম বলেন, “ডিসেম্বরের পরে আমরা আরো দুইটি জরিপ করবো। একটি জরিপ তাদের জন্য যারা এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে স্বাক্ষরতা শিখেছেন তাদের জ্ঞান যাচাইয়ের জন্য। অন্যটি পূর্বের জরিপের মত করা হবে। কেননা যদি কেউ পূর্বের জরিপে বাদ যান তাহলে তাদেরকে চিহ্নিত করা হবে এবং এই কার্যক্রমের সাথে যুক্ত করা হবে।”