নোয়াদিয়া গ্রামের প্রবীণ ও বয়স্ক শিক্ষার্থীদের গল্পের আসর
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
শিক্ষার কোন বয়স নেই সেই কথাটি প্রমাণ করলেন নেত্রকোনা জেলায় কেন্দুয়া উপজেলায় বলাইশিমুল ইউনিয়নের ‘ধান-শালিক-নদী-হাওর’ যুব সংগঠনের সদস্যরা। লিখতে ও পড়তে পারেনা গ্রামের এমন ৩০জন প্রবীণ ও প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর (পুরুষ) নিক্ষরতা দূরীকরণের জন্য যুব সংগঠনটি জানুয়ারি ২০১৭ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। যুব সংগঠনের উদ্যেগে বয়ষ্ক শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ-বই, খাতা, কলম, কাঠ পেন্সিল, ব্ল্যাকবোর্ড সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন সন্ধায় ২ ঘন্টা করে ৫ জন যুবক শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব পালন করে। দশ মাস লেখাপড়া শেষে ১০ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে বয়স্ক শিক্ষার্থীদের একটি মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হয় যুব সংগঠনের উদ্যোগে। মূল্যায়ন পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়া, লেখা, সুন্দর হাতের লেখা, নাম ঠিকানা, মজার মজার গল্প বলা ও অভিনয় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। নোয়াদিয়া একতা উচচ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ইউপি মেম্বার, গণ্যমান্য ব্যাক্তি ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাদির ধান-শালিক-নদী-হাওর যুব সংগঠনের কাজগুলোর প্রশংসা করে বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে যদি এই ধরণের যুব সংগঠন তৈরি হয়, তাহলে সমাজে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।’ তিনি নিজে থেকে বয়স্কদের বিনোদনের (খেলার) জন্য একটি কেরামবোর্র্ড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে স্বাক্ষরজ্ঞান প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অনুভুতি প্রকাশ করেন। প্রবীণ শিক্ষার্থী মো. আব্দুল মোমেন অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘আগে আমরা স্বাক্ষর জানতামনা, পড়তে পারতামনা কিন্তু এই স্বাক্ষরতা কেন্দ্রে পড়াশুনা করে আমাদের এখন গর্ব হচ্ছে লেখাপড়া ও নাম স্বাক্ষর করতে পারি বলে। এখন মরেও শান্তি পাব, কেউ বলতে পারবেনা যে, আমরা নিরক্ষর ও অশিক্ষিত।’ তিনি সকল বয়সের নারী-পুরুষকে অন্তত নিজের নাম স্বাক্ষর শেখার পরামর্শ দেন।
প্রবীণ শিক্ষার্থী জজ মিয়া বলেন, ‘আগে আমি নাম লিখতে পারতাম না। আমার নিজের কাছেই শরম লাগত। এই বয়সে এসে আমি নিজের নাম ঠিকানা লিখতে ও পড়তে পারি”। এই বলে জজ মিয়া অনুষ্ঠানে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বয়ষ্ক স্বাক্ষরতা কেন্দ্র পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য যুব সংগঠনের উদ্যোক্তা বাপ্পী, সোয়েল, মোখলেছ ও ইমনদের দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
অরেক প্রবীণ শিক্ষার্থী মো. আব্দুস সাত্তার বলেন, “আমি আগে টিপসই দিতাম, এখন আমি লিখতে ও পড়তে পারি। মরণের আগে নাম লিখতে ও পড়তে পারছি বলে আমার অনেক গর্ব হচ্ছে।” ৩০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৫ জন শিক্ষার্থী তাদের নাম, ঠিকানা লিখতে ও বই পড়তে পারে। ১৫ জন শুধুমাত্র তাদের নাম ঠিকানা লিখতে পারে এবং অক্ষর চিনতে পারে। অনুষ্ঠানে প্রবীণ শিক্ষার্থী ও অংশগ্রহণকারীরা মজার মজার গল্প বলে সকলকে বিনোদন দেয়। বিচারকগণ ৩০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম নির্বাচিত করে পাঁচজন শিক্ষার্থীকে পুরষ্কৃত করেন। ধান-শালিক-নদী-হাওর সংগঠনের কার্যক্রম দেখে পার্শ্ববর্তী গ্রামে নিজ উদ্যোগে আরো দু’টি যুব সংগঠন গড়ে উঠেছে।
ধান-শালিক-নদী-হাওর যুব সংগঠনের এ ধরণের মহতি উন্নয়ন উদ্যোগের ফলে ৩০ জন প্রবীণ ও প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠী জীবন সায়ান্নে এসে লেখাপড়া শিখতে সক্ষম হয়েছে। যুব সংগঠনটি বৃক্ষ রোপণ, বিলের কচুরিপানা পরিষ্কার করাসহ স্কুল পর্যায়ে ইস্যুভিত্তিক বক্তৃতামালা আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের সাধারণ জ্ঞান চর্চা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিশেষভাবে অবদান রাখছে। যুব সংগঠনটির সফলতা কামনা করছি।