কুমুদিনী হাজংকে বারসিক’র সন্মান ও শুভেচ্ছা
নেত্রকোনা থেকে মো: অহিদুর রহমান
১৮ জানুয়ারি ২০২২। ব্রিটিশ শাসন ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ টংক প্রথা বিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী মুখ কুমুদিনী হাজংকে শুভেচ্ছা, সম্মান ও ভালোবাসা জানাতে, তাঁর জীবনের গল্প শুনতে বহেরাতলীর ঢিলায় নিজ বাড়িতে নেত্রকোনার বারসিক পরিবার কিছুটা সময় কাটান। শুভেচ্ছা ও সম্মান জানাতে শীতের গরম কাপড়, কোকারিজ, নগদ টাকা ও তার সম্মাননা স্বারক, পুরস্কার, রাখার জন্য একটি সুকেস প্রদান করা হয়।
সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়, সুমেশ্বরী নদী, কুল্লাগরা ইউনিয়ের বহেরাতলী পাখি ডাকা গাছগাছালি ঘেরা ছোট ছোট ঢিলার এক গ্রাম। আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ঢিলার উপরে লাল সবুজের ঘর, ঘরের ছালে বাগানবিলাস ফুল। ফুল ঝরে পড়ে পরিচ্ছন্ন উঠোনে। সেই ফুল ঝাড়– দিয়ে রোগ পোহাতে বসে আছে ঐহিহাসিক টংক আন্দোলনের নেত্রী সাহসী যোদ্ধা বাংলার নারীদের প্রেরণা প্রায় শতবর্ষী নারী (৯৩) কুমুদিনী হাজং।
ব্রিটিশ বিরোধী ঐতিহাসিক টংক আন্দোলন ও হাজং বিদ্রোহের সাক্ষী কুমুদিনী হাজং দ্বিতীয় বিশ্বয্দ্ধু, পরবর্তী টংক আন্দোলন, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানি জুলুম বৈষম্য, নিপীড়ন, ১৯৬৪ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মহান স্বাধীনতা আন্দোলন তিনি দেখেছেন। আমরা বারসিক পরিবার ও কলমাকান্দা বহুত্ববাদি সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাতে গিয়েছিলাম বহেরাতলীর এই ঢিলায় কুমুদিনী হাজংয়ের কাছে।
আমাদের আগমন জেনেই তিনি বুঝতে পারলেন কেউ হয়তো দেখতে এসেছেন। তিনি তাঁর নাতনী লিপিকে চেয়ার আনতে বললেন। তাঁকে প্রণান জানালে তিনি গ্রহণ করলেন। ¯পষ্ট করে কথা বলতে পারেন না, কানে কম শুনেন। চলাফেরা করতে পারেন না। বয়সের ভারে টংক আন্দোলনের বীভৎস উত্তাল দিনগুলোর কোন কিছুই মনে করতে পারছেন না।
সুমেশ্বরী নদীর জল এখন কম। আছে বালু নিয়ে হরিলুট, ব্যবসা। সেই নদীতেই টংক আন্দোলনের সংগ্রামী হাজং নারী পুরুষদের লাশ ভেসে গিয়েছিল। রক্তে লাল হয়েছিল। আর বহেরাতলীর সবুজ মাঠে মানুষের জমিতে ফলে সোনালি ধান, সবুজ শাকসবজি। কৃষকেরা স্বাধীনভাবে ফসল ঘরে তোলেন। নেই কোন অসম প্রথা। নাই জমিদারের খড়গ। আর সেই কৃষকের ফসল স্বাধীনভাবে ঘরে তোলার জন্য রাশমনি হাজং, কুমুদিনী হাজং, যাদুমনি হাজং, সুরেন্দ্র হাজং সংগ্রাম করেছেন, নিজের গায়ের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন সুমেশ্বরী নদীর তীরে নদীর জলে। বৈষম্যে, জুলুমের টংক প্রথা বাতিল হয়েছে ১৯৫০ সালে।
কুমুদিনীর জীবন শুরু হয়েছিল দারিদ্রতার মাঝে। ৯৩ বছর পরও অন্যের সাহায্য সহযোগিতা আর দয়ায় বেঁেচ আছেন তিনি সরকারি খাস জমির উপর। যার কোন কাগজপত্র নেই কুমুদিনীর হাতে। তার তিন ছেলে দুই মেয়ে। মেজো ছেলে অর্জুন হাজং কুমুদিনীর সাথে থাকেন। তিনি শ্রমিকের কাজ করেন। বড় ছেলে লমিন হাজং থাকেন বিজয়পুর গুচ্ছ গ্রামে। ছোট ছেলে মহাদেব হাজং থাকেন ভারতের আশ্রমে। বড়মেয়ে মেনজুলি হাজং দুর্গাপুর বিয়ে হয়েছে স্বামীর সাথে থাকেন মানিকগঞ্জে। স্বামী শ্রমিকের কাজ করেন। আর ছোট মেয়ে অঞ্জলি হাজং স্বামীর সাথে ঢাকায় থাকেন।স্বামী শ্রমিকের কাজ করেন।
বৃহত্তর ময়মনসিংহে সুসঙ্গ জমিদার এলাকায় টংক প্রথার প্রচলন চালু হয়। হাজংদের জমিতে ফসল হউক বা না হউক নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান জমিদারদের খাজনা প্রদান করতে না পারলে অত্যাচার চলতো। হাজং কৃষকদের মাঝে এই আন্দোলন প্রচন্ডভাবে দানাবাধে।
১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি। গ্রামের সকল কৃষক মাঠে কাজ করতে গিয়েছে। নিরব, শান্ত সবুজ গ্রাম। শিশুরা বাড়ির আঙিনায় খেলছে। গ্রামে চলে আসে ব্রিটিশ পুলিশ দল। টংক আন্দোলনকারীদের খোঁজ করার নামে আন্দোলনকারী কৃষক হাজং নেতা কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজংকে ঘরে না পেয়ে নববধু কুমুদিনীকে জোর করে টেনেপিঁঁঁছড়ে নিয়ে চলে দুর্গাপুর পুলিশ ফাঁড়ির দিকে। এই খবর পেয়ে বহেরাতলী গ্রামের রাশিমনি হাজং শতাধিক নারী পুরুষ নিয়ে দেশী দা, ঝাড়–, বল্লম, লাঠি, তীর ধনুকসহ সুমেশ্বরী নদীর তীরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কুমুদিনীকে ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু পুলিশ কোন কথাই না শুনে টেনেপিঁছড়ে নববধু কুমুদিনীকে দুর্গাপুরের সেনাছাড়নির দিকে নিয়ে চলে। রাশমনি দা দিয়ে এলোপাতারি কুপাতে থাকেন। তিনি একজন পুলিশকে দা দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলেন। পুশিলের গুলিতে রাশিমনি হাজং নিহত হন। সহযোদ্ধা সুরেন্দ্র হাজং সেই পুলিশকে কুপিয়ে মেরে ফেলেন। তারপর পুলিশের গুলিতে ২২ জন হাজং কৃষক নারীপুরুষ মারা যায়। বেগতিক দেখে পুলিশ চলে যায়। গ্রামবাসী ভবিষ্যতে আরো বড় হামলার ভয়ে লাশগুলো সুমেশ্বরী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পরদিন ব্রিটিশ পুলিশ বহেরাতলী গ্রামে তান্ডব চালায় এবং গ্রামকে তছনছ করে ফেলে।
কুমুদিনীর স্বামী মারা গেছেন ২০০০ সালে। ১৯৫০ সালে টংক প্রথা বিলুপ্তির পর হাজংদের উপর জুলুম অত্যাচার নেমে আসে। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ভারতে চলে যায়। স্বাধীনতার পর ফিরে এসে দেখে তার ৪ আড়া জমি দখল হয়ে গেছে । যা আজও উদ্ধা করতে পারে নাই।
কুমিদিনী হাজং টংক প্রথা বিরোধী যুদ্ধে পরাজিত হন নাই। পরাজিত হয়েছেন বার্ধক্যের কাছে। পরাজিত হয়েছেন নিজের জমি উদ্ধারের সংগ্রামে। তিনি আমাদের কাছে গর্ব ও গৌরবের সংগ্রামী মুখ। প্রেরণার উৎস। আমাদের নেত্রকোনা তথা বাংলাদের আদিবাসী নারী তথা সকল নারী সমাজের প্রতিকৃত।
তিনি বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মনান অর্জন করেছেন। অনন্যা শীর্ষ দশ নির্বাচিত হন ২০০৩ সালে, ২০০৫ সালে স্বদেশ চিন্তা সংঘ ড. আহম্মদ শরীফ স্বারক্ষ পুরস্কার লাভ করেন, লাভ করেন মনিসিংহ স্মৃতিপদক-২০০৭, ১৯৯৯ সালে তেভাগা কৃষক আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তিতে স্বামী লংকেশ্বরকে সংবর্ধনা প্রদান, সিধু কানহু ফুলমনি পদক-২০১০, জলশিঁড়ি পদক-২০১৪, হাজং জাতীয় পুরস্কার-২০১৮, নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক কর্তৃক সম্মানা স্বারক্ষ-২০২১ প্রদান করা হয়।
বেলা পড়ে আসছে, ঢিলার ঢালু বেয়ে নীচে নেমে এলাম সবুজ ঘাসে । পিছনে ঢিলার উপর নীরব লালসবুজের ঘরে রেখে এলাম এক সংগ্রামী আন্দোলনকারী কিংবদন্তী নারীকে যার জীবনটা একটা জীবন্ত উপন্যাসের মতো একটি দেশ, একটি পৃথিবীর মতো বিশাল। সমাজ আন্দোলনের চেতনার প্রতীক।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও আসামের সীমান্ত রক্ষা চলেছে গারো পাহাড়। সুমেশ্বরী নদীর জলে,পাহাড়ের উচ্চতায়, বহেড়াতলী গ্রামের সবুজ গাছের ডালে পাখি গানে, কৃষকের বাঁিশর সুরে সবখানে ছড়িয়ে আছে টংক আন্দোলনের সংগ্রামী নারী কুমুদিনী হাজংয়ের বিজয়গাঁথা। গারো পাহাড়ে আছে গারো, হাজং, বানাই, কোচ আদিবাসী। আদিবাসীদের আছে ঐতিহাসিক সংগ্রামের ইতিহাস, আছে জীবনের গল্প, আছে রক্ত ঝরার গল্প। আছে হাজং বিদ্রোহ, গারো আন্দোলন, পাগলপন্থী আন্দোলন, হাতিখেদা আন্দোনের ইতিহাস। আছে রাশমনি হাজং এর বীরত্বগাথা রক্তের ইতিহাস, কুমুদিনী হাজংয়ের ঐতিহাসিক ব্রিটিশ বিরোধী টংক প্রথা আন্দোলনের ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনামলের ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের হাজং বিদ্রোহের সাক্ষী এই বিপ্লবী নারী কুমুদিনী হাজং।