জলবায়ু পরিবর্তনে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বলতর হচ্ছে
সিলভানুস লামিন
কেন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে সেই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। গবেষক, বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিজ্ঞানী নানান প্রমাণ, তথ্য, উপাত্ত দিয়ে বিশ্বের মানুষকে জলবায়ু পরিবর্তনের নেপথ্যে কারণগুলো তুলে ধরেছেন যেখানে তারা দেখিয়েছেন যে, মানুষের কার্বননির্ভর জীবন-জীবিকায় এই পরিবর্তনকে তরান্বিত করেছে। ধনী দেশের মানুষেরা ভোগবিলাসিতার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি, তেল, রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করছেন, নতুন স্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বন উজার করেছেন, মুনাফার উদ্দেশ্যে বিশ্বের ভুখণ্ড, সমুদ্র ও আকাশকে বিভিন্ন ক্ষত-বিক্ষত করেছেন; আরাম-আয়েশ জীবনের জন্য প্রতিনিয়ত গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে চলেছেন, যা জলবায়ুকে অতিদ্রুত গতিতে পরিবর্তন করেছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আদিবাসীরা যে কম দায়ি-একথাটি একাধিকবার বলা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনে যারা সবচে’ ক্ষতিগ্রস্ত বা শোচনীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে তার মধ্যে আদিবাসীরা হচ্ছে অন্যতম। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের ফলে প্রাণবৈচিত্র্যের বিস্তৃতি হ্রাস পাবে, বিলুপ্তির হার বৃদ্ধি পাবে, প্রজনন বা বংশবিস্তারের সময়ের পরিবর্তন ঘটবে, প্রজাতির বৃদ্ধি ও প্রতিবেশগত পরিসরের পরির্তন ঘটবে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও পরিমাণ উভয়ই বেশি সংঘটিত হচ্ছে; প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল সাধারণ গরিব মানুষ বিশেষ করে আদিবাসীদের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি তাই এই পরিবর্তনে সবচে’ বেশি বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। এজন্য বিশ্বে ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ হিসেবে আদিবাসীদের সংখ্যা দিনে দিন বাড়তে থাকছে।
আর্কটিক অঞ্চলের আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রানমশ বিষয়ে সবচে’ স্পর্শকাতর এলাকা হচ্ছে আর্কটিক অঞ্চল। এজন্য এ অঞ্চলকে জলবায়ু পরিবর্তনের ‘ব্যারোমিটার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এই ব্যারোমিটারের ‘পারদ’ হিসেবে আদিবাসীদেরকে বিবেচনা করা হয়েছে। এই অঞ্চলের আদিবাসীদের পেশা মূলত পশুপাখি ও মৎস্য শিকার, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক বন হ্রাস, বরফের পুরুত্ব হ্রাস, প্রাণী প্রজাতির বৈচিত্র্যে, সহজলভ্যতা ও সংখ্যায় পরিবর্তন, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও পরিমাণ বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চ বৃদ্ধির কারণে এই এলাকার আদিবাসীরা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে যেমন পারছেনা তেমনিভাবে এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য দিনে দিনে হ্রাস পাওয়ায় যেসব উদ্ভিদ ও প্রাণী আদিবাসীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো সেগুলো সহজলভ্য না হওয়ায় এ এলাকার আদিবাসীদের সংস্কৃতিও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের বরফ গলে যাওয়ায় শ্বেত ভালুক, বরফে বসবাস করে শীল জাতীয় প্রাণী এবং অন্যান্য শীতল এলাকার প্রাণীর বসবাসের অনুকূল পরিবেশ কমে যাওয়ায় এসব প্রাণী ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্রিডিংয়ের ওপর প্রভাব, অভিবাসনের পথ তলিয়ে যাওয়া এবং পশু বিচরণক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ার কারণে স্যামি আদিবাসীদের শিকার জীবনে বিপর্যয় নেমে আসছে। ফলশ্রুতিতে ‘শিকার’ পেশার সাথে জড়িত এসব আদিবাসীদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শিকারের পেশার সাথে জড়িত মানুষেরা স্যামি সংস্কৃতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা স্যামি ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক; তবে যদি এই জনগোষ্ঠী কোনভাবে শিকার করে টিকতে না পারে তাহলে স্যামি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির ভিত্তি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
নিকারাগুয়ার মিসকিতো আদিবাসীদের জীবিকা
নিকারাগুয়ায় মিসকিতো নামক প্রায় ৮৫ হাজারের আদিবাসী বাস করে। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে এসব আদিবাসী পাহাড়ি অঞ্চলের কয়েক হেক্টরের জমিতে শস্য-ফসল চাষ করে এবং বন-জঙ্গল ও নদীগুলোতে বিভিন্ন খাদ্য আহরণ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। আধুনিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত এ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের সবচে’ বেশি ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বন্যা এবং শীতকালে খরা পরিস্থিতির কারণে এই মানুষগুলোর জীবন-জীবিকা যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি কৃষিকাজকে কেন্দ্র আবর্তিত সাংস্কৃতিক চর্চাগুলোও ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, ২০৭০ সালে কেন্দ্রীয় আমেরিকায় তাপমাত্রা ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে এবং বৃষ্টিপাত সংঘটনের হার ২৫% কমে যাবে। এ অঞ্চলের আদিবাসীদের খরা, বন্যা, ঘুর্ণিঝড়সহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে হবে, যা অনেকক্ষেত্রে তাদের জন্য কঠিন হবে। এই আদিবাসীদের গ্রামগুলোর কাছে Rio Coco নামে একটি নদী প্রবাহিত হলেও বর্তমানে নদীটি ভরাট হয়ে পড়েছে; ফলে আদিবাসীদের যাতায়াত ও মালামাল বহনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। উপরোন্তু ওই অঞ্চলে পানি সঙ্কট ও দূষণ দুটোই মহামারী আকার ধারণ করায় আদিবাসীরা কলেরা, ম্যালেরিয়াসহ নানান রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া ওই এলাকায় বনাঞ্চল উজাড়ের প্রবণতা অনেক বেশি। বনাঞ্চল উজারের কারণে আদিবাসীদের প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎস হ্রাস পাচ্ছে এবং প্রকৃতির বিভিন্ন উদ্ভিদকনা, লতাপাতা ও অন্যান্য প্রাণী যেগুলো আদিবাসীরা ওষুধ এবং সমাজে বিভিন্ন পার্বন ও উৎসবগুলোতে ব্যবহার করে সেগুলো আর সহজলভ্য না হওয়ায় এই আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক চর্চা বিপন্ন হচ্ছে।
বাংলাদেশের খাসি আদিবাসীদের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিপন্ন
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই প্রকৃতিনির্ভর খাসিদের কৃষিও আজ বিপন্ন। পান চাষের জন্য বৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু বৃষ্টি পানির প্রাপ্যতা কম হওয়ার কারণে বিগত পাঁচ বছরে খাসিদের পান চাষ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এ বছর (২০২১) সালে মৌলভীবাজার জেলার তুলনামূলকভাবে বৃষ্টি অনেক কম; বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে যেখানে খাসিরা পান চাষ করেন। এতে করে পান চাষ প্রক্রিয়ায় নানান পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, ব্যাহত হয়েছেন পান উৎপাদন, নতুন চারা রোপণ ও পান সংগ্রহ করার হার। বলা যায়, জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে অতীতের চেয়ে খাসিদের পান উৎপাদন কমছে, কমছে মাটির উর্বরাশক্তি, বাড়ছে রোগবালাই। ফলে অতীতে যেভাবে ঋতুভেদে পান চাষ প্রক্রিয়া তারা অনুশীলন করতো সেটাতে ব্যাঘাত ঘটেছে। জুন-জুলাই মাসে পানের চারা কাটা ও রোপণের সময় এবং এক কেন্দ্র করে সামাজিক আচার-পার্বণ পালন হলেও বর্তমানে অনেকে সেটা অনুসরণ করতে পারছেন না ঋতু পরিবর্তনের কারণে। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ‘লংখং’ (পান গাছের সব পান পাতা তুলে ফেলা) ও নতুন পান তোলার সময় হলে বর্তমানে অনেকে জানুয়ারি মাসের দিকেই জুমের সব পান তুলতে বাধ্য হচ্ছেন। নতুন পান এপ্রিল-মে মাসে তোলা হলেও বর্তমানে মে মাসের দিকে তারা নতুন পানের পাতা তুলতে পারছেন। অর্থ্যাৎ স্বল্প ও বৃষ্টিহীনতার কারণে খাসিদের পানচাষের পঞ্জিকা পরিবর্তন হচ্ছে। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে নিরিয়ুস বুআম বলেন, ‘জুন-জুলাই মাসে পান জুমে পানের চারা রোপণ করে থাকি আমরা। কিন্তু এ বছরসহ বিগত বছরগুলোতে বৃষ্টির পরিমাণ এত কম যে, আমরা প্রয়োজন ও চাহিদা মাফিক নতুন চারা রোপণ করতে পারি না উপরোন্তু নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত স্বল্প বৃষ্টির কারণে জুন-জুলাই মাসে রোপণকৃত ওই পানের চারাগুলো খরায় মরে যায়।’ অন্যদিকে ভারুত লামিন বলেন, বিগত ৪/৫ বছর থেকেই শীতকালে খুব শীত আর গ্রীষ্মকালে খুব গরম অনুভূত হচ্ছে। এই শীতের সময় অতিরিক্তি শীতের কারণে পানের পাতাগুলো রাঙা (হলুদ রঙ ধারণ করে) হয়। রাঙা পানের মূল্য খুবই কম। এছাড়া বর্ষার সময় বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় পান উৎপাদন কমছে। ফলে আমরা পানচাষ করে খুব একটা লাভবান হতে পারিনি।’
ফিচার ফটো: সাজু মারছিয়াং