অচাষকৃত উদ্ভিদ এর সাথে হারিয়ে যাচ্ছে খাদ্য ও পুষ্টির উৎস
রাজশাহী থেকে ইসমত জেরিন
বাংলাদেশ, প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর একটি দেশ। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রঙে সাজে এই দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর এই দেশের মানুষ বরাবরই প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে প্রকৃতি থেকে বিভিন্নভাবে তাদের প্রয়োজনগুলো মিটিয়ে এসেছেন। আমরা যদি শহর আর গ্রামের মানুষের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে যে, শহরের মানুষের তুলনায় গ্রামের মানুষেরা অনেক বেশি প্রকৃতির কাছাকাছি থাকেন এবং সরাসরি প্রকৃতির উপরে নির্ভর করেন। একটি সময় ছিল যখন গ্রামের মানুষকে বাজার থেকে শাকসবজি খুব কম ক্রয় করতে হতো। তাদের আশেপাশের জমিতে যে শাকসবজি জন্মাতো সেগুলো দিয়েই তারা তাদের প্রয়োজন মেটাতো, প্রচলিত ভাষায় যাকে আমরা অচাষকৃত শাকসবজি বলে থাকি। এগুলো যেমন তাদের দৈনন্দিন খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতো। তেমনি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করতো।
বর্তমানে বিজ্ঞানের বদৌলতে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এবং বাজার ব্যবস্থার প্রভাবের ফলে সেই পূর্বের অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। তবে গ্রামের সাধারণ মানুষেরা এখনও মনে করেন যে, এই পরিবর্তনটা গ্রামে পুরোপুরি শুরু হয়নি। অনেক পরিবার আছে যারা নিয়মিত বাজার থেকে শাকসবজি ক্রয় করতে পারেন না। ফলে তাদেরকে নির্ভর করতে হয় এই সমস্ত অচাষকৃত শাক-সবজির উপর। সুতরাং এই শাকসবজিগুলো কমে গেলে সেই সব পরিবারের খাদ্য, পুষ্টি এবং অর্থনীতির উপরে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক চাষকৃত আর অচাষকৃত শাকসবজি কি? খুব সংক্ষেপে বললে, যেগুলো মানুষ জমি চাষ দিয়ে বীজ বপন করে সারাবছর যতœ করে ফলান সেগুলোকে চাষকৃত সবজি বা ফসল বলে। যেমন: আলু, টমেটো, সীম, লাল শাক, মুলা প্রভৃতি। অপরদিকে, যে সবজিগুলো মানুষ বীজ বপন করে চাষ করে না বা কোন পরিচর্যা করার প্রয়োজন হয় না সেগুলোকে অচাষকৃত সবজি বলে। যেমন: বথুয়া শাক, শানচি শাক, কলমি শাক, কাঁটাখুড়া শাক ইত্যাদি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ এলাকার মতো বরেন্দ্র অঞ্চলের পতিত জায়গা ও বাড়ির আশপাশের প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন শাকসবজি জন্মে থাকে। এসব অচাষকৃত শাকসবজির মধ্যে রয়েছে শানচি, গিমা, শুনশুনি, বথুয়া, নোনতা, ডুমুর, হেলেনঞ্চা সহ প্রায় ৪০ প্রজাতির উদ্ভিদ। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এসব উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে মানুষের বিভিন্ন পুষ্টির উৎস। গ্রাম অঞ্চলের মানুষের এই খাবারগুলো থেকে পুষ্টির চাহিদা অনেকটা পূরণ হয়ে থাকে। তবে নানা কারণেই বরেন্দ্র অঞ্চলসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে এসব উদ্ভিদের কোন কোনটি বিলুপ্ত হয়েছে কিংবা কোন কোনটি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
অধিকাংশ বরেন্দ্র অধিবাসীদের মতে, জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার, অচাষকৃত উদ্ভিদগুলোকে আগাছা হিসেবে দেখা এবং প্রাকৃতিক ও মানুষ সৃষ্ট নানান দুর্যোগের কারণে এসব উদ্ভিদ আজ হ্রাস পেয়েছে। আধুনিক কৃষি আসার পর থেকেই অচাষকৃত এসব উদ্ভিদকে মানুষ আগাছা মনে করা শুরু করেছে। ফলশ্রুতিতে জমিতে এবং জমির আশাপাশে জন্মানো এসব উদ্ভিদ তারা উপড়ে ফেলতে শুরু করে। অন্যদিকে জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে এসব উদ্ভিদ রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ায় মারা যায়। আবার দেখা যায়, একই প্রজাতির ফসল চাষ এবং মানব সৃষ্ট নানান কর্মকান্ডের কারণে এসব অচাষকৃত উদ্ভিদগুলোর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের বড়শি পাড়া গ্রামকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এই গ্রামের অচাষকৃত খাদ্যের এই উৎসগুলো এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। কিছু কিছু উপাদান আছে যেগুলো ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর কিছু আছে যেগুলো বিলুপ্তির পথে। গ্রামবাসীর মতে, নিকট অতীতেও সকলের বাড়ির আনাচে কানাচে, ফসলের জমিতে, রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি জন্মাতো। কিন্তু সেগুলো এখন অনেকটাই কমে এসেছে।
আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিই হচ্ছে এগুলো বিলুপ্তির প্রধানতম কারণ। পূর্বে যেভাবে চাষাবাদ করা হতো তাতে খাদ্যের এই উৎসগুলোর কোন ক্ষতি হতো না। কিন্তু আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমিতে যে শাক বা সবজিগুলো থাকে সেগুলো মারা যায়। পূর্বে যেগুলোকে খাবার মনে করা হতো এখন সেগুলোকে আগাছা মনে করা হয়। পাশাপাশি ফসলের জন্য ক্ষতিকারকও মনে করা হয়। ফলে জমি চাষ করার পূর্বেই সেগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। এই রাসায়নিক সার বা কীটনাশকগুলো যে শুধু জমির খাদ্য উপাদানগুলোকে ধ্বংস করছে তা নয়; পাশাপাশি প্রভাব পড়ছে বাড়ির জমির আশেপাশে থাকা খাদ্য উপাদানগুলো উপরও। ফলে বাড়ির আনাচে কানাচে যে শাকসবজিগুলো হতো-সেগুলো এখন কমে যাচ্ছে। অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের ফলে শাকসবজিগুলোর পরাগায়নে যে পাখিগুলো ভূমিকা রাখে সেই পাখিগুলোও এখন কমে যাচ্ছে। ফলে এরও প্রভাব পড়ছে এই খাদ্য উপাদানগুলোর উপরে।
এই অচাষকৃত উদ্ভিদের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কৃষির আধুনিকায়ন এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার তো রয়েছেই পাশাপাশি অধিক জনসংখ্যাও অন্যতম কারণ। অধিক জনসংখ্যার ফলে পতিত এবং চাষের জমির ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। গ্রামবাসীর মতে, ১০ বছর আগে যেখানে ২টি বাড়ি ছিল সেখানে এখন ২০টি বাড়ি হয়েছে। ফলে যে জমিগুলোতে এই শাকসবজিগুলো জন্মাতো সেই জমির পরিমাণ এখন কমে গেছে। যেখানে একসময় কাঁটাখুড়া শাক হতো সেখানে এখন মানুষ চলার রাস্তা হয়েছে। এখন মানুষ আর সেগুলোর দিকে খেয়াল করে না। কারণ বাজারে গেলেই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ক্রয় করতে পারছেন। কিন্তু তাই বলে যে, সেই সমস্ত শাকসবজি খাবার ইচ্ছা মানুষের মধ্য থেকে চলে গেছে তা কিন্তু নয়; এখনও বাজারে যদি সেগুলো নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে সেগুলোই সবার আগে বিক্রয় হয়।
গ্রামাঞ্চলের মানুষের খাদ্যের একটি অন্যতম উৎস হল এই অচাষকৃত শাকসবজি। পরিবেশগত কারণই হোক বা আধুনিক চাষাবাদ ব্যবস্থাই হোক অথবা জনসংখ্যা বৃদ্ধিই হোক আমাদের নিকট থেকে খাদ্যের এই উৎসগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকে এগুলোর জন্য আফসোস করেন। আবার অনেকেই গুরুত্বই দেন না। বিশেষ করে প্রবীণরা এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। তবে যারা এই খাবারগুলো খেয়ে বড় হয়েছেন তারা এগুলো হারিয়ে ফেলতে চান না। তারা চান, খাদ্যের এই উৎসগুলো টিকে থাকুক। কিন্তু কি করলে সেগুলো টিকে থাকবে সেটি অনেকে বুঝে উঠতে পারেন না। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাদের পক্ষে কোন কিছু করা সম্ভব হয় না।
তবে আশোর কথা হচ্ছে, এখনও গ্রামাঞ্চলে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা অচাষকৃত এই উদ্ভিদগুলোকে টিকিয়ে রাখতে চান তাদের প্রয়োজনেই। তেমনি একজন নারী হলেন, বড়শি পাড়া গ্রামের তাজমিনা বেগম (৩৫)। তিনি এই বিষয়টি অনুধাবন করেন এবং তাঁর নিজস্ব এক কাঠা জমিতে বিভিন্ন ধরনের অচাষকৃত শাকসবজি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে তিনি ১০ প্রজাতির (লটা খুড়া, কাটা খুড়া, বথুয়া, কলমি, গাদা পুইয়া, চিকন সাঞ্চি, মোটা সাঞ্চি, তুলসি, এ্যালোভেরা) উদ্ভিদ সেখানে রোপণ করেছেন এবং নিয়মিত পরিচর্যা করছেন। তাঁর বিশ্বাস, তাঁর এই উদ্যোগ দেখে আরো অনেকে অনুপ্রাণিত হবেন এবং তাঁর মতো করে তাঁরাও এই অচাষকৃত শাকসবজিগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উদ্যোগী হবেন। তাজমিনা বেগম বলেন,“অচাষকৃত উদ্ভিদের সংরক্ষণের জন্য আমার মতো আরো উদ্যোগী নারী তৈরি হওয়া দরকার। আর সেটার জন্য দরকার নিরন্তর কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ বা সহযোগির ভূমিকা পালন করা।”
সবুজ বিপ্লবের পর কৃষিক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষি জমির পরিমাণ যেভাবে কমেছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে উৎপাদন। পরিবর্তন এসেছে সরকারি উৎপাদন নীতিমালায়, কাজের ধরনে পরিবর্তন এসেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এর সবকিছুই হয়েছে বর্ধিত সকল মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। কিন্তু এতো কিছু পরিবর্তন করার পরও কি সকল মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? হ্যাঁ, অধিকাংশ মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করা গেছে এটি আমরা বলতেই পারি। কিন্তু যাদের খাদ্য নিশ্চিত করা যায় নি তাদের জন্য আমরা কি কোন বিকল্প চিন্তা করছি? তারা তো নিজেদের খাবার নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিতে শিখেছেন । কিন্তু আমরা আধুনিক চাষাবাদ ও সকলের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে গিয়ে তাদের খাবারের উৎসগুলো নষ্ট করে দিয়েছি। তাদেরকে বাজারের উপরে নির্ভর করতে দিয়েছি। তাদের এখন যত কষ্টই হোক না কেন তাদেরকে এখন বাজারে যেতে হবে। কিন্তু আমরা যদি তাদের কথাটিও মাথায় রেখে নীতিমালা তৈরি করতাম। তাহলে তাদের খাবারের উৎসও ঠিক থাকতো। আবার সকলের জন্যও খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হতো। তারপরও তাজমিনা বেগমের মত কিছু মানুষ আছেন যারা চেষ্টা করছেন, কিভাবে সেই উৎসগুলোকে সংরক্ষণ করা যায় এবং প্রজাতি বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখা যায়।