সুন্দরবনকে ভালোবাসি
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা ও সুন্দরবন দিবস। ভালোবাসা দিবসে এক অপরের ভালোবাসার মানুষকে ফুল, চিঠি, কার্ড ও বিভিন্ন উপহার দিয়ে ভালোবাসা জানিয়ে দিবসটি উৎযাপন করেন। একই তারিখে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পালিত হয় সুন্দরবন দিবসও। উল্লেখ আছে যে, ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন খ্রিস্টান চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের-অভিযোগে তৎকালীন রোমান স¤্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে বন্দী করেন। কেননা তখন রোমান রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। সেই দিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউ ও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন’ দিবস ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই শুরু বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এদিকে ২০০১ সালে প্রথম পালিত হয় সুন্দরবন দিবস। উল্লেখ আছে যে, ২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রূপান্তর ও পরশ এর উদ্যোগে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মে¥লনে আরো প্রায় ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠন অংশগ্রহণ করে। উক্ত সুন্দরবন সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সুন্দরবন দিবস ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই প্রতিবছর সমগ্র বাংলাদেশে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবন দিবস উৎযাপিত হয়।
পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। বিশ্ব ঐতিহ্যখ্যাত নয়নাভিরাম এ প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি খ্যাত সুন্দরবন আজ সময়ের পরিক্রমায় হুমকির মুখে পড়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৭ লক্ষাধিক পরিবার সরাসরি এই সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও প্রায় ২ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ও জীবন-জীবিকা কমবেশি নির্ভরশীল। সুন্দরবনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে উপকূলীয় এ অঞ্চলের কৃষি পরিবেশ ও প্রতিবেশ। সুন্দরবননির্ভর পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার মান-উন্নয়ন ও সুন্দরবনের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার জন্য সমাজ সচেতন সকলকে সুন্দরবন দিবসের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে।
রামসার ঘোষিত এই সুন্দরবনে ৫ হাজার প্রজাতির সম্পূরক উদ্ভদি, ১৯৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৭৯ প্রজাতির পাখি, ১২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ৩০ প্রজাতির চিংড়ী মাছ রয়েছে। নানা বৈচত্র্যময় সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। সুন্দরবনের বনজ, মৎস্য ও পর্যটন খাত থেকে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়ে থাকে। প্রতিবছর দেশী ও বিদেশী বহু পর্যটক পাড়ি জমায় সুন্দরবনে, প্রকৃতির নির্মল পরিবেশে থেকে হৃদয়কে খানিকটা হালকা করার জন্য। বাংলাদেশের সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা লাভ করা সম্ভব।
সুন্দরবনের মানকে বিশ্বের দরবারে সমুজ্জ্বল রাখতে এবং সুন্দরবন সুরক্ষায় নানা ধরনের পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। সুন্দরবন দিবসের মাধ্যমে সকলকে সুন্দরবন সুরক্ষায় সচেতন করতে হবে। র্যালি, আলোচনা, সেমিনার, মতবিনিময়, গোলটেবিল বৈঠক, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ এবং ডকুমেন্টরি প্রদর্শনীর মাধ্যমে সুন্দরবন সুরক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম ও স্কুল কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুন্দরবন বিষয়ক রচনা, চিত্রাংকন, গল্প ও কবিতা প্রতিযোগিতা আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের মননশীল চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যেতে পারে।
প্রকৃতির অফুরন্ত প্রাণ সম্পদে ভরা বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে সুরক্ষার জন্য সরকারি ও বেসরকারি সকল মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। চিন্তা, চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে সুরক্ষা করতে হবে। তাহলে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছাস ও নদী ভাঙনের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে প্রাণ ও বৈচিত্র্য সুরক্ষা পাবে। তাই শুধু বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে নয়, শুধু সুন্দরবন দিবসে নয় বরং আসুন আমরা সবাই আমাদের বৈচিত্র্যেভরা প্রিয় সুন্দরবনকে ভালোবাসি সতত!