সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় জলাবদ্ধতা; চিন্তায় বর্ষার আগেই ঘুম হারাম!
সাতক্ষীরা থেকে এসএম শাহিন আলম
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব এবং তার সাথে আছে মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের শেষ জেলা সাতক্ষীরা। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙ্গা নিয়ে মানুষ যেমন শঙ্কিত তেমনি দ্রুত নগরায়নের ফলে শহর ছেয়ে যাচ্ছে কংক্রিটের মোড়কে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
বছরের বড় একটি সময় জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ জলাবদ্ধতায় নাকাল হয়ে পড়ে। বিশেষত সাতক্ষীরা পৌরসভার মধ্যে এই সমস্যা প্রকট। প্রথম শ্রেণীর এই পৌরসভার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা একেবারে অপরিকল্পিত। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় পৌরসভার বিভিন্ন অংশ জলাবদ্ধতায় তলিয়ে থাকে। বর্ষা মৌসুমে যে পানি জমে তা পৌর শহরের প্রায় অর্ধেক এলাকায় ছয়-আট মাস ধরে জমে থাকে। সামান্য বর্ষণ থেকে ভারী বর্ষণ হলেই ঘরের ভেতর থেকে শুরু করে টয়লেট, সবখানে পানি থাকায় রান্নাসহ গৃহস্থালির কাজে মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাতে হয় লক্ষাধিক মানুষকে। কোমর পর্যন্ত পানিতে নেমে যাতায়াত করতে হয় স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ সববয়সের মানুষকে। একটানা পানি জমে থাকার কারণে রাস্তাঘাটসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে, লবণাক্ততার প্রভাবে বাস্তুতন্ত্রে ও জীববৈচিত্র্যের অবস্থা হয় শোচনীয়। প্রতিবছর কৃষি ও মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকা।
সাতক্ষীরা পৌরসভার রাজার বাগান এলাকায় বাড়ি হওয়ায় জলবদ্ধতার মারাত্মক ভুক্তভোগী আমরা। আশানুরূপ এলাকাটি একটু নিচুই বলা চলে, আর সেখানে গড়ে ওঠা বহুতল ভবনগুলো পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করেই হাকানো হয়েছে। তাই বর্ষা মৌসুম আসলেই সব বয়সের মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়। কিছু কিছু এলাকায় আট মাস পর্যন্ত সেই পানি স্থায়ী থাকে। রাস্তায় হাঁটু থেকে কোমর পানি, ঘরের অবস্থা নাই বললাম। খাদ্য, পানি, স্যানিটেশনের তীব্র সংকট দেখা দেয়। মাচান পদ্ধতিতে বাস করে অনেকে, রাতের জন্য অপেক্ষা করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। রীতিমতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাসের পর মাস ডুবে থাকায় রাস্তায় পাঠ দান করার মতো ঘটনাও ঘটে। মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে।
সাতক্ষীরা উপকূলে বিভিন্ন ঝড়ে বাঁধ ভেঙ্গে মাস কিংবা বছর ধরে ডুবে থাকা আর শহরে জলাবদ্ধ হয়ে আট মাস থাকা দুরহ ব্যাপার। জোয়ারে পানি আসে ভাটায় সরে যায়, কিন্তু শহরে বদ্ধ হয়ে থাকে। তাই পানি আর পানি থাকে না, হয়ে যায় বিষাক্ত। পানিতে শরীরের অঙ্গ স্পর্শ করলে নানা রকম চর্ম রোগ দেখা দেয়। জল, মলসহ বিভিন্ন প্রাণী মরে পচে যায়। পানি হয়ে যায় বিষ।
আসছে বর্ষা মৌসুম, আতংকিত হয়ে উঠছে সাতক্ষীরার মানুষ। এজন্য এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে যে খাল বা নদী প্রবাহিত হয়েছে, সেখানে নেটপাটা কিংবা বাঁধ দিয়ে পানির গতি রোধ করা হয়, সেগুলো অপসারণ করতে হবে। জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সমন্বয়ে মনিটরিং করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের ড্রেনেজ ব্যবস্থা আগেই পরিষ্কার করতে হবে।
সাতক্ষীরা শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত প্রাণসায়ের খালের সাথে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর কার্যকর সংযোগ স্থাপন করতে হবে। নদীর গতিপথ বাড়ানোর জন্য গভীরভাবে খনন করা যেমন প্রয়োজন তেমনি খাল কিংবা নদীর সাথে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অতি প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে জলাবদ্ধতার সংকট দূর করা সময়ের দাবি এবং এই লক্ষ্যে উপযুক্ত গবেষণা ও তার বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
(লেখাটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের জলাবদ্ধতা নিরসনে করণীয় বিষয়ক ক্যাম্পেইনের একটি অংশ)
লেখক: সাতক্ষীরা পৌরসভার রাজার বাগানের বাসিন্দা এবং সদস্য, শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা টিম