‘ভাড়া গরুর হাল’ এখন শুধুই একটি ইতিহাস

তানোর রাজশাহী থেকে  শহিদুল ইসলাম শহিদ     

বর্তমানে আর কোথাও চোখে পড়ে না ভাড়া গরুর হাল। একসময় জনপ্রিয় এবং খুব কাজের সেই ভাড়া গরুর হাল আর বাইতে দেখা যায় না কোন কৃষককে। ভাড়া গরুর হাল এখন তাই শুধুই একটি ইতিহাস। অতীতে কৃষকরা পাশের প্রতিবেশী কৃষকদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। এই সহযোগিতার মধ্যে ‘গরু ভাড়া’ দেওয়ার বিষয়টি অন্যতম। তবে কৃষির আধুনিকায়নের পর থেকে লোকায়ত এই চর্চাটি আজ আর দেখাই যায় না। নিত্যনতুন কৃষি উপকরণ আসার পর থেকেই ‘গরুর হাল’ অপ্রচলিত হয়েগেছে। কৃষক এখন আধুনিক যন্ত্র দিয়ে জমি প্রস্তুত করেন।

IMG_20170115_085654
আগের কৃষি ব্যবস্থায় হাল মানেই হালের গরু ছিল প্রধান। পরিবারে কোন ধরনের সমস্যা বা রোগের চিকিৎসা করার জন্য বেশি টাকার প্রয়োজন হলে কেউ কেউ হালের গরু বিক্রিও করতেন। তাই বলে কি তার হাল বন্ধ থাকে? না থাকে না। কারণ রয়েছে ভাড়া গরুর ব্যবস্থা। পাড়ার মধ্যে যাদের গরু বেশি আছে তারা দু’টি গরু ৫- ৬ মণ ধানের বিনিময়ে একটি মৌসুমের জন্য ভাড়া দিয়ে থাকেন। আবার অনেকের গরু আছে কিন্তু গরু দেখাশুনার লোকের অভাব রয়েছে। এ ধরনের মানুষেরা গরু ভাড়া দিয়ে থাকেন।  ফসল উঠানোর পর গরু ও ধানসহ তার মালিকের কাছে জমা দিয়ে আসতেন। এতে করে সম্পর্কের পরিধি আরও বৃদ্ধি পেত। শুধু কৃষিক্ষেত্রেই নয়; সকল পেশাগতদের আদান প্রদানের সম্পর্ক এখন দিন দিন কমে যাচ্ছে। এমনটি জানালেন রাজশাহী গোদাগাড়ীর রিশিকুল গ্রামের মো. জুয়েল হোসেন (৩৮)। একই কথা জানান তানোর নুসরাত নার্সারির মালিক আবুল বাসার। তিনি বলেন, ‘একজোড়া গরু ছিল একজন কৃষকের বড় হাতিয়ার। হাল চাষের ও মইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন মালামাল বহন করতেন গরুর গাড়িতে করেই। আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে যেতেও গরুর গাড়ির ব্যবহার করতেন অনেকে। তাই একজোড়া গরু কিনতে না পারলেও একটি গরু থাকলে লক্ষ্য থাকতো আর একটি ভাড়া নিয়ে জোড়া করার।”
অন্যদিকে ‘ভাড়া গরুর হাল’ কৃষকদের মধ্য থেকে একে অপরকে সহযোগিতা এবং পারস্পারিক বিনিময়ের একটি চর্চা। এক সময়ে অভাব হলে সংসারের বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে অপরজনকে সহযোগিতা করতেন গ্রামের মানুষ। এমনকি কোন কৃষক ফসল চাষে পিছিয়ে পড়লে সকলে মিলে একদিন তাঁকে সহযোগিতা করতেন গ্রামের অন্য কৃষকরা। বিনিময়ে টাকা নয়; আনন্দ করে তাঁর বাড়িতে তারা ডাল, ভাত খেতেন। আজ সেই সোনালি অতীত আর নেই। কালের পরিক্রমায় সেই চর্চাটি যেমন আর নেই তেমনিভাবে সুন্দর ও সৌহার্দ্য সম্পর্কও দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে তানোরের আদর্শ কৃষক নুরমোহম্মদ (৬৮) বলেন, ‘শুধু ভাড়া গরুর হাল নয়, মানুষ ভাগেও হাল করতেন। দুই পরিবার থেকে দু’টি গরু দিয়ে একটি হাল দাঁড় করতেন সেই হাল দিয়ে দুই জনেরই জমি চাষ করা হতো। ভাড়া হালের গরুকে কেন্দ্র করে তৎকালিন সময় থেকেই বরেন্দ্র অঞ্চলে একটি প্রবাদ ছিল। যেমন অনেকে মজা করে বলতেন, ‘পারেনা কোনটা? বাড়িরটা, মার সালা ভাড়ারটা।’ হাল চাষের সময় বাড়িরটা না পারলেও ভাড়ারটাকে মারার কথা মজা করে বলতেন।’

IMG_20170115_085536
যান্ত্রিক কৃষির কাছে মার খেয়েছে কৃষকের পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চা। এই প্রসঙ্গে নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার কুন্তইল গ্রামের মতিলাল মুর্মু (৫০) বলেন, “আজ থেকে ২০ বছর আগে আমার নিজেরই ভাড়া গরুর হাল ছিল। আষাঢ় মাস পড়লেই জমিতে পানি জমে যেত নিজের মতো করে সেই হাল দিয়ে জমিতে চাষ দিতে পারতাম। এখন কলের লাঙল দিয়ে অন্যের দ্বারা নগদ টাকায় চাষ দিয়ে নিতে হয়।” তিনি আরও বলেন, “সামান্য জমি হলে কলের লাঙল মালিকরা জমি চাষ করে দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তাই সময় মতো পাওয়া যায় না। এছাড়াও মনের মত চাষও হয় না। কিন্তু এখন আর কি করার? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়।”

অতীতে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে বৃষ্টি হওয়া শুরু হতো, ভাদ্র মাস পর্যন্ত জমি চাষ করার সময় পেতেন কৃষকরা। কিন্তু বর্তমানে বর্ষার সেই রূপ আর নেই। এখন হঠাৎ করে বৃষ্টি হয় আবার দীর্ঘ সময় বৃষ্টি নেই। তাই মানুষ আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে অতি তাড়াতাড়ি মাটি তৈরি করতে পাচ্ছে। এভাবে কালের পরিক্রমায় কমে গেছে গরুর হাল। প্রয়োজনের কারণে অতীতে প্রত্যেকে গরু পালন করতেন কিন্তু এখন আগ্রহ কমেছে। ফলে চাহিদা ও আগ্রহ না থাকায় কৃষক হারিয়েছে ভাড়া গরুর হালও।

happy wheels 2

Comments