একজন আত্মপ্রত্যয়ী দূর্গার কথা

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা।

কুপির তেল ফুরানোর আগেই বই বন্ধ করতে হয়। আজকের বাংলাদেশ আর ২০ বছর আগের বাংলাদেশে মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক। বর্তমান সরকার বাংলাদেশে সব গ্রামে বিদ্যুতের আলো পৌছে দেবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ।

এক সময় বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকার গ্রামগুলোতে রাতের অন্ধকার দূর করতে নির্ভর করতে হয়েছে হারিকেন ও কুপির আলোর উপর। এর মধ্যে কিছু দরিদ্র পরিবার এতটাই দরিদ্র ছিল যাদের হারিকেন বা কুপি কিনার মত ক্ষমতা ছিলনা। তারা পুরনো কালির দোয়াত কুড়িয়ে এনে তা দিয়ে কুপি (বাতি) তৈরি করে তাতে কম দামে কেরোসিন কিনে ব্যবহার করতেন। গ্রামের সেই অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চর্চা এখনও সচল রয়েছে দলিত সম্প্রদায়ের কিছু পরিবারের মধ্যে। এমনই একটি পরিবার হচ্ছে দূর্গা রবিদাসের পরিবার। তিনি নেত্রকোনা জেলা সদরের মালনী ঋষি পাড়ার রিপন রবিদাসে স্ত্রী।

দূর্গা রানী
দূর্গার জন্ম ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল উপজেলার ঘাটাইল থানা বাম্মন শাসন গ্রামের একটি দলিত পরিবারের। গ্রামের যে পাড়ায় দূর্গা জন্ম গ্রহণ করেন সেখানে ২০ থেকে ২৫টি রবিদাস পরিবারের বসবাস। জুতা সেলাই, চামড়া বিক্রয় একসময় পরিবারগুলোর প্রধান ব্যবসা থাকলেও বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা সেলুনের কাজ করে। দূর্গার বাবা মেকানিক্সের কাজ করতেন। দুই বোন ও এক ভাই এবং মা বাবাকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার দূর্গার । বাবা যা আয় করতেন তা দিয়ে কোন রকম সংসার চলতো। সংসারের অভাব থাকলেও দূর্গা নিজের সন্তানদের পড়াশুনা শেখানোর ইচ্ছে থাকায়, ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতেন। দলিত পরিবারের সন্তানদের জন্য সাধারণ গ্রামের ছেলে মেয়েদের সাথে পড়াশুনা করা খুবই কঠিন কাজ ছিল। একে তো সামাজিক বাধা ,সেই সাথে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল থাকায় স্কুলে পোষাক, ভালো জুতা কেনার মতো ক্ষমতা থাকে না তাঁদের। হাজার বাধার মধ্যেও দূর্গার বড় ভাই এসএসসি পাশ করে সেলুনের কাজ শুরু করেন।

দূর্গাও এসএসসি পাশ করেছেন। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করার পর থেকেই পড়াশুনা করে নিজের পরিবার ও সমাজের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দূর্গা। নিজ গ্রামের একটি বড় সমস্যা বাল্য বিবাহ। দূর্গার সমবয়সী প্রায় সবার বিয়ে হয়ে গেছে, তাই দরিদ্র বাবা মা তার বিয়ের জন্য যেমনি হোক বর খুজতে থাকে। এমনি অবস্থায় পরিবারে ও সমাজের নানা বাধাকে উপেক্ষা করে দূর্গা দূর্গা পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দরিদ্র পিতার আয়ে কলেজের খরচ চালানো সম্ভব হবে না জেনে দূর্গা নিজেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করে তাঁর পড়াশোনার খরচ যোগাড় করে। কলেজ ও টিউশনি শেষে রাতে পড়তে বসে কুপি জ্বালিয়ে। দূর্গা কুপির সলতে সব সময় নিচে নামিয়ে রাখে যাতে বেশি তেল খরচ না হয় কিংবা দ্রুত ফুরিয়ে না যায়! পড়া শেষ করার আগেই তাঁকে বিছানায় যেতে হয় ঘুমাতে কেরোসিনের তেলের ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে!

দূর্গা রাণী
অতি কষ্ট করে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া দূর্গা এখন অনার্স পাশ করেছেন। এরই মাঝে তাঁর বিয়ে হয়েছে নেত্রকোনা সদরের মালনী ঋষিপাড়ার একটি পরিবারের ছেলের সাথে, যিনি সেলুনের কাজ করেন। নিজের স্বজাতির মধ্যে শিক্ষিত ছেলে সংখ্যা কম। তার উপর দূর্গার জন্য সে রকম একটি ছেলে প্রয়োজন ছিল যে যৌতুক ছাড়া বিয়ে নিবে। স্বামী রিপন দূর্গার পড়াশুনা দেখে বিনা যৌতুকেই বিয়ে করে আনে। বিয়ের পর দূর্গা অনার্স পাশ করেন।

বিয়ের পর স্বামীর এলাকাতে এসে নিজ গ্রামের চেয়েও আর করুণ অবস্থা দেখেন দূর্গা। মালনীতে ১৩৫ দলিত পরিবারের মধ্যে ৩ থেকে ৪ জন ছেলে মেয়ে কলেজ পর্যন্ত পৌছেছে। এখানের বাল্য বিয়ের প্রকোপ বেশি। দূর্গার মতে, বাল্য বিয়ে বন্ধের একমাত্র পথ হচ্ছে শিক্ষালাভ করা। তিনি নিজে তাঁর বাল্য বিয়ে বন্ধ করেছেন পড়ালেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে! দূর্গা বলেন, ‘দলিত পরিবারগুলো এখনও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকার কারণ আর্থিক নয়; মূল কারণ সামাজিক অসচেতনতা ও শিক্ষাহীনতা।’ তাই পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোকে সামনে দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দূর্গা নিজের পাড়ার সবুজমনা দলিত পরিবারে প্রবীণ ব্যক্তি রঙ্গু ঋষি উদ্যোগে তৈরি শিশু বিকাশ কেন্দ্রে পাঠ দান শুরু করেন।

এই শিশু বিকাশ কেন্দ্রের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করছে বারসিক। বারসিক স্কুলে উপকরণ সহায়তা, অভিভাবকদের সাথে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ নিয়ে সচেতন সৃষ্টি ও সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে। দূর্গা ও রঙ্গু ঋষির এ উদ্যোগ বর্তমানে এগিয়ে আসছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ফলে স্কুলটিকে বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে তৈরির কার্যক্রম চলছে। স্কুল পরিদর্শন করেছেন নেত্রকোনা জেলা পরিষদের কর্মকর্তাগণ।

জেলা পরিষদের উদ্যোগে স্কুলে অবকাঠামোর উন্নয়নে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছে যার কার্যক্রম শুরু হবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে।  দূর্গা নিজে সংসার, সন্তান সব সামলে দলিত শিশুদের নিয়ে এলাকার মানুষের জন্য স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে তোলা স্কুলে নিয়মিত কাজ করছেন। নিজের স্বপ্নগুলোকে অন্য ছেলে মেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে, সামাজিক ও পারিবারিক বাধাগুলো দূর করে একটি সুন্দর বহুত্ববাদী সমাজ গড়ে তোলাই তাঁর লক্ষ্য।

happy wheels 2

Comments