নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে বরাদ্দ বাড়াতে হবে
ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ
১৯৯৬ সালের বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়, খাদ্য কোনোভাবেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। কিন্তু তারপরও আমরা দেখতে পাই খাদ্যকে ঘিরে নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক চাপ এবং নিয়ন্ত্রণ। আবার দেখা যায়, কেবলমাত্র মানুষের খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করতে গিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণ-প্রজাতির খাদ্য ভান্ডারকে সমূলে শেষ করে দেয়া হয়। খাদ্য হিসেবে মানুষের ভাত উৎপাদনের জন্য ধান ক্ষেতে ব্যবহার করা হয় নানা ক্ষতিকর আগাছানাশক, কীটনাশক ও রাসায়নিক সার। এভাবে মৃত্যু ঘটে শৈবাল, অণুজীব থেকে শুরু করে নানা লতাগুল্ম, মাকড়সা, শামুক, কেঁচো, ব্যাঙ ও ছোট মাছের। হয়তো এভাবে মানুষের জন্য উৎপাদিত খাবার ভাতের থালা ভরে সামনে চলে আসে কিন্তু প্রকৃতির অন্যান্য সদস্য মারা যাওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়ে পাখি, গরু, ছাগল, মুরগি ও অন্যান্য প্রাণীরা। আজকের দুনিয়ায় খাদ্য তাই কেবল ক্ষুধা নিবারণের বিষয় শুধুমাত্র নয়। আজ ভাবতে হবে এর উৎপাদন, সরবরাহ, মজুতকরণ, বিপণন, বিনিময়, বন্টন, প্রবেশাধিকার থেকে শুরু করে কার জন্য খাদ্য এবং কীভাবে এই খাদ্য সকলের জন্য সমানভাবে সুরক্ষিত থাকছে। তার মানে খাদ্যের মতো এক মৌলিক অধিকার আজ বিশ্বব্যাপি সকলের জন্যই এক প্রধান মৌলিক তর্ক হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
একটা সময় ‘অধিক খাদ্য ফলানোর’ প্রচেষ্টা থাকলেও দুনিয়া আজ স্থায়িত্বশীল খাদ্য উৎপাদনের দিকে ধাবিত হতে বাধ্য হচ্ছে। এখন খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিবেশ, প্রতিবেশ, বৈচিত্র্য, সংস্কৃতি এবং জনগোষ্ঠীর আকাংখাকেও গুরুত্ব দেওয়ার চল শুরু হয়েছে। প্রতি বছর জাতিসংঘ ঘোষিত ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে পালিত হয়। এ বছরের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যে ‘খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়িয়ে স্থানান্তরের ভবিষ্যত বদলানোর’ আহবান জানানো হয়েছে। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া কী পৃথিবীজুড়েই খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে কৃষির সনাতনী ধারায়। খাদ্য উৎপাদনের মূল কারিগর এখনও কৃষক ও কৃষিজমি। যদিও পৃথিবীতে কেবলমাত্র উৎপাদন নয়, অনেক জনগোষ্ঠী বিষেশত গ্রামীণ নারীরা কিছু খাদ্য সংগ্রহ করে থাকেন নানা প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় রাষ্ট্রেই দিন দিন কৃষিতে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও জাতীয় বাজেট কমে যাচ্ছে। কৃষিতে কৃষকের মঙ্গলের স্বার্থে ভর্তুকীর পরিমাণ একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে। নিরাপদ খাদ্যের প্রসঙ্গ না হয় বাদই রাখলাম, কথা হলো খাদ্য উৎপাদনে এভাবে বরাদ্দ কমতে থাকলে কীভাবে সকলের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে? আর খাদ্য উৎপাদনের মূল স্থলগুলো এখনো বিশ্বের প্রাচীন বসতি গ্রামগুলো। যেহেতু নগরীয় কৃষি এবং বাণিজ্যিক খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র খাদ্য নিরাপত্তায় খুব একটা ভূমিকা রাখে না তাই গ্রামীণ খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকেই বরাদ্দ বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তার ভিতকে মজবুত রাখা জরুরি।
প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ মনুষ্যসৃষ্ট নানা দূর্যোগের পাশাপাশি বিশ্ব আজ জলবায়ু সংকটের মতো এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। দূর্যোগে প্রাণ, প্রকৃতিসহ জানমালের যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হয় তেমনি এক বিশাল অংশ দূর্যোগের ফলে বাস্তুচ্যুত হয়। টিকে থাকার প্রয়োজনে চলে আসে শহরে এবং জড়িত হয় নানা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়। এভাবে দূর্যোগের প্রভাব গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই দেখা যায়। দূর্যোগে সবচে’ বেশি ভোগান্তি হয় নারী, শিশু, প্রবীণ, আদিবাসী ও বিশেষভাবে সক্ষম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। এমন অবস্থায় খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষককে আরো বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এক দূর্যোগপ্রবণ দেশ। কিন্তু দূর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকার এক আশ্চর্য শক্তি ও ক্ষমতা আছে এই দেশের। এখানকার মাটি, পানি, ভূগোল, জনজীবন, প্রাণ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি দূর্যোগ মোকাবেলার সাহস সঞ্চয় করে চারপাশ থেকে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অকাল বন্যা, পাহাড়ি ঢল, বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের পাশাপাশি মুনষ্যসৃষ্ট দূর্যোগও এখন বাংলাদেশের জন্য টিকে থাকার নতুন সংকট তৈরি করেছে। পাহাড় ধস, গার্মেন্টসভবনসহ অবকাঠামো ধসে পড়া এবং এমনকি জীবনবাঁচাতে পালিয়ে আসা ভিন্ন দেশের উদ্বাস্তু নাগরিকরাও দেশে দূর্যোগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এমন অবস্থায় খাদ্য উৎপাদন খোদ কৃষকের একার পক্ষে কীভাবে সামাল দেয়া সম্ভব? কোনো ধরণের বিশেষায়িত বাজেট ও সুস্পষ্ট চাহিদামাফিক বরাদ্দ ছাড়া? কারণ প্রতিদিন বদলাচ্ছে জলবায়ুগত সংকট এবং দূর্যোগের ধরণ। এই সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে নানা শর্ত ও প্রয়োজন হচ্ছে নানা কারিগরি ও উপকরণ সহায়তা। আর এসব ক্ষেত্রে আর্থিক, নীতিগত এবং সম্পদ বরাদ্দ একটি মৌলিক প্রশ্ন। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে তাই কৃষি এবং গ্রামীণ উন্নয়নে ভিন্ন অঞ্চল ও চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
কোনোভাবেই ভুলে গেলে চলবে না আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার মূল কারিগর ও উৎসস্থল আমাদের গ্রামীণ নারী। আর তাই বিশ্বব্যাপি আমরা ঘোষণা করেছিলাম, ‘খাদ্য জোগায় নারী’। ১৯৯৫ সালেই গ্রামীণ নারীদের খাদ্য উৎপাদনসহ বহুমুখী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের স্বীকৃতির জন্য বেইজিং সম্মেলনেই প্রতি বছরের ১৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সাল থেকে এই দিবস বিশ্বের গ্রামীণ নারীদের অধিকার বাস্তবায়নে সংগঠিতভাবে পারিত হচ্ছে। Women’s World Summit Foundation (WWSF) এর উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ নারীর অধিকার বাস্তবায়নে এই দিবসের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয় এবং পৃথিবীর প্রায় ১০০টিরও বেশি দেশ এই দিবসটি গুরুত্ব দিয়ে পালন করা শুরু করে।
বাংলাদেশ এক দূর্যোগপ্রবণ দেশ। কিন্তু দূর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকার এক আশ্চর্য শক্তি ও ক্ষমতা আছে এই দেশের। মাত্র দু’দিন আগে ১৩ অক্টোবর বিশ্বব্যাপি পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক দূর্যোগ প্রশমন দিবস। দিবসটি পালন করতে গিয়েও আমরা বলেছি বাংলাদেশের মাটি, পানি, ভূগোল, জনজীবন, প্রাণ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি দূর্যোগ মোকাবেলার সাহস সঞ্চয় করে চারপাশ থেকে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অকাল বন্যা, পাহাড়ি ঢল, বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের পাশাপাশি মুনষ্যসৃষ্ট দূর্যোগও এখন বাংলাদেশের জন্য টিকে থাকার নতুন সংকট তৈরি করেছে। পাহাড় ধস, গার্মেন্টসভবনসহ অবকাঠামো ধসে পড়া এবং এমনকি অন্য দেশ থেকে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা দুর্গত মানুষেরাও দেশে নতুন দূর্যোগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। দূর্যোগে প্রাণ, প্রকৃতিসহ জানমালের যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হয় তেমনি এক বিশাল অংশ দূর্যোগের ফলে বাস্তুচ্যুত হয়। টিকে থাকার প্রয়োজনে চলে আসে শহরে এবং জড়িত হয় নানা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়। এভাবে দূর্যোগের প্রভাব গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই দেখা যায়। দূর্যোগে সবচে’ বেশি ভোগান্তি হয় নারী, শিশু, প্রবীণ, আদিবাসী ও বিশেষভাবে সক্ষম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর।
বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীর রয়েছে দূর্যোগ মোকাবেলার এক অসাধারণ শক্তি ও অভিজ্ঞতা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী নানা সামাজিক বঞ্চনাকে সামলান, তেমনি নারীকে দূর্যোগের আগে-পরে ও দূর্যোগকালিন নানা সংকট মোকাবেলা করতে হয়। দূর্যোগের আগে প্রস্তুতি হিসেবে নারীরা বীজ, শুকনো খাবার ও মূল্যবান জিনিস আলাদাভাবে সংরক্ষণ করেন। দূর্যোগকালিন সময়ে পরিবারের শিশু-প্রবীণ ও প্রাণিসম্পদের সুরক্ষাও নারীরাই দেন। এমনকি দূর্যোগ পরবর্তী ঘরদোর মেরামত থেকে শুরু করে গৃহস্থালী কৃষি পুনর্বাসনের কাজ গুলিও করে থাকেন গ্রামীণ নারী। তাছাড়া আবহাওয়া ও দূর্যোগের পূর্বাভাষ বিষয়ে গ্রামীণ নারীর রয়েছে এক ঐতিহ্যগত জ্ঞান। কিন্তু নারীর এই দূর্যোগ মোকাবেলার অবদান সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃত হয়না। দূর্যোগ মোকাবেলায় জাতীয় কর্মসূচি ও নীতিতে বরাবরই গ্রামীণ নারী থাকেন উপেক্ষিত ও অবহেলিত। দূর্যোগ পূর্বাভাষ থেকে শুরু করে দূর্যোগে সেবা-সহযোগিতা কী ত্রাণ বা ব্যবস্থাপনা সকল কিছুতেই নারীর অংশগ্রহণকে বিবেচনা করা হয়না। দেখা যায় নারীর জন্য প্রযোজ্য নয় এমন বিষয় গুলোই হয় ত্রাণ নয় দূর্যোগ পরবর্তী সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ দেয়া হয়। এমনকি দূর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র গুলো নারীবান্ধব নয়। স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদে দূর্যোগ ও নারী বিষয়ক আলাদা স্ট্যান্ডিং কমিটি থাকা সত্ত্বেও সেখানে নারী জনপ্রতিনিধিদের কথা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না। গ্রামীণ নারীর দূর্যোগকালিন সংকটকে গভীরভাবে বিবেচনা করা জরুরি। দূর্যোগে নারী এবং বিশেষত বয়:সন্ধিকাল পাড়ি দেয়া কিশোরীরা যেসব সমস্যা মোকাবেলা করেন সেসব ভালোভাবে বোঝা জরুরি। দূর্যোগ মোকাবেলায় গ্রামীণ নারীর শক্তি ও নানাবিধ কৌশলগুলোকে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা জরুরি। গ্রামীণ নারী ব্যক্তি হিসেবে দূর্যোগ মোকাবেলায় যে অবদান রাখছেন তা কেবল একটি পরিবার নয়, তার নিজের গ্রাম এবং পুরো বাংলাদেশকেই সুরক্ষা দেয়। আমরা মনে করি, দূর্যোগ মোকাবেলায় গ্রামীণ নারীর এই অসামান্য অবদানকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দেয়া জরুরি।
প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দূর্যোগের কারণে প্রতিনিয়ত বাস্তুচ্যুত হয়ে স্থানান্তরিত হচ্ছে কৃষক, গ্রাম থেকে নগরে। কমছে খাদ্য উৎপাদনের কৃষিজমিও সহজপ্রাপ্য দেশিয় উপকরণ ও প্রাণসম্পদগুলো। সবদিক থেকেই এক সংকটময় সময় পাড়ি দিয়েও বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারাকে সমুন্নত রাখবার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে দেশের একটা বড় চ্যালেঞ্জ সকলের জন্য নিরাপদ খাবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর এজন্য খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ উন্নয়নে কাংখিত মনোযোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। আর এটি নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতের নানাবিধ স্থানান্তর ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে, নগরে বাড়বে মানুষের চাপ ও জীবন হয়ে ওঠবে দু:সহ। আমরা কেউ এই দুঃসহ পরিস্থিতি চাই না। তাই এখন থেকেই আমাদের সকলকে একযোগে গ্রামীণ উন্নয়নে কাজ করতে হবে। বারসিক ও পবা দীর্ঘদিন থেকেই নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে কাজ করে আসছে। আমরা জানি এ কাজ আমাদের কারোর একার পক্ষেই সামাল দেয়া সম্ভব নয়, চাই সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা। নিরাপদ খাদ্যের জোগানের ভেতর দিয়ে ভবিষ্যতের সকল দূর্যোগ মোকাবেলায় চাই সকল স্তরের এক সমন্বিত জাগরণ।
এ পরিস্থিতিতে আমরা কী করতে পারি? একেবারেই একজন ভোক্তা ও ক্রেতা হিসেবে প্রথমত আমরা খাদ্যটাকে নিরাপদ দেখতে চাই। নিরাপদ মানে ক্ষতিকর ও বিপদজনক রাসায়নিকমুক্ত খাদ্য। এ অবস্থায় খাদ্য উৎস ও উৎপাদনস্থলকেই প্রথমত নিরাপদ করাটা জরুরি। তারপর থাকছে খাদ্য সরবরাহ, পরিবহন, বিপণন, মজুতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিবেশন। জমির মাটি থেকে খাবার থালা অবধি খাদ্য নিরাপদ হওয়া জরুরি। খাবার নিরাপদ কিনা এ নিয়ে নিয়মিত খাদ্য পরীক্ষাটাও জরুরি। আমরা যেমন খাবারে কোনো ভেজাল চাই না, আবার ফরমালিন-কার্বাইড বা ক্ষতিকর কোনো উপাদান খাবারে মিশে থাকুক তাও চাইনা। আবার খাদ্য উৎপাদনের পরিবেশ এবং কোন ধরণের শস্যজাত থেকে খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে তাও পরখ করেই দেখতে চাই। প্রতিদিন দেশে কমছে কৃষিজমি এবং প্রাকৃতিক পানির উৎসস্থলগুলো। আমরা কৃষিজমি ও জলাভূমিকে বাঁচাতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে অধিক খাদ্য ফলানোর নামে খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে সংহারী বীজ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। এরপর খাদ্য বিপণনের নানা স্তরে ভেজালদ্রব্য তো থাকছেই। ক্ষতিকর কীটনাশক, আগাছানাশক, ছত্রাকনাশক মাটির অণুজীব থেকে শুরু করে শামুক-কেঁচো-উপকারী পতঙ্গ সব মেরে ফেলছে। দূষিত করছে সামগ্রিক পরিবেশ। মানবস্বাস্থ্য ক্রমেই হুমকীর মুখে পড়ছে। প্রতিবছর লিচু মৌসুমে বিশেষত দিনাজপুর অঞ্চলে বিষমাখা লিচু খেয়ে মারা যাচ্ছে অবোধ শিশুরা। শস্যক্ষেতে বিষ ছিটানোর পর গ্রামবাসীর হাঁস-মুরগি সেই জমিতে প্রবেশ করে মারা মরছে এবং এ নিয়ে গ্রামে প্রতিবেশীর সাথে নানা দরবার লেগেই আছে। জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে তার অবশেষ জমা হচ্ছে জলাশয়ে। এভাবে মরছে দেশি মাছের বৈচিত্র্য। পাশাপাশি জলজ জীব ও জলচর পাখিদের জন্যও এটি খাদ্যসংকট তৈরি করছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সাতক্ষীরায় পরিচালিত কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব শীর্ষক এক গবেষণায় বারসিক দেখতে পায় এসব অঞ্চলে বহুজাতিক সিনজেনটা, এসিআই ও পদ্মা কোম্পানির কীটনাশক কৃষকেরা বেশি ব্যবহার করে থাকেন। বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ বাসুডিনের মতো কীটনাশকও এসব অঞ্চলে দেদারসে বিক্রি ও ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৭ সনের আগষ্টে সাতক্ষীরা সদর, শ্যামনগর, কলারোয়া, তালা ও কালীগঞ্জ উপজেলার ৬০০ কৃষকের মাঝে পরিচালিত এ গবেষণায় জানা গেছে, ৯৮.৩৪ ভাগ কৃষক কীটনাশক ব্যবহার করেন। এর ভেতর ৬১.৫৩ কৃষক ক্যান্সার, লিভারের সমস্যা, বহুমূত্র, শ্রবণ সমস্যা, কিডনি জটিলতা, শারিরীক ও মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হওয়ার মতো নানা জটিলতায় ভুগছেন। কৃষকেরা দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে কীটনাশত স্প্রে করেন। জমিতে স্প্রে করার সময় ৭৫ ভাগ কৃষকের শরীরে সরাসরি কীটনাশক ছিটকে পড়ে। অধিকাংশ কৃষক স্প্রে করার পর হাত ও শরীর না ধুয়েই খাবার খান এবং ৫৪ শতাংশ কৃষক কীটনাশক ছিটানোর সময় কোনো প্রতিরোধমূলক পোশাক পরেন না। স্প্রে করার পর কীটনাশকের খালি প্যাকেট ও বোতল নষ্ট করা হয় না এবং এগুলো যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়। কীটনাশকের এই ক্ষতিকর প্রভাব শুধু মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে না তা পরিবেশ দূষণও ঘটাচ্ছে। কীটনাশকের এরকম অবাধ ব্যবহার কৃষির ফলন বাড়াচ্ছে কিন্তু খাদ্যকে করে তুলছে বিষাক্ত, যা খাওয়ার পর মানুষ আরো নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তা সারিয়ে তোলার জন্য আরো বেশি সময়, মনোযোগ ও অর্থ নষ্ট হচ্ছে। এই গবেষণার ভেতর দিয়ে কীটনাশকের মাঠপর্যায়ের ক্ষতিকর দিক এবং খাদ্যকে নিরাপদ করে তোলার জন্য কৃষক পর্যায় থেকে ভোক্তা সকল স্তরেই একটি জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে বারসিক। এই গবেষণার ফলাফলের সূত্র ধরে আবারো আমাদের বলার বিষয় হলো অবশ্যই খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, কিন্তু এই বরাদ্দ যেন অনিরাপদ বিষাক্ত খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত না হয়। দেশিয় শস্যবৈচিত্র্য ব্যবহার করে প্রাকৃতিক নিয়মে জৈব উপায়ে কৃষিকাজের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন সম্ভব।
এমনকি চাষাবাদের জন্য জমিতে সরাসরি রাসায়নিক প্রয়োগ নয়, আরো অন্যান্য ক্ষেত্রেও খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়েও দূষিত ও হুমকীতে পড়ছে খাদ্য। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখতে পেয়েছে, অপরিশোধিত পোল্ট্রি বর্জ্য সরাসরি জমিতে ও জলাধারে ব্যবহারের কারণে শাকসব্জিতে ঢুকে পড়ছে রোগজীবাণু। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের গবেষকেরা গাজর, করলা, ব্গেুন, লাউ, শসা, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, মরিচ ও ঝিঙ্গায় সালমোনেল্লা ও ই-কোলাই ব্যাক্টেরিয়া সণাক্ত করেছেন যা টাইফয়েড ও ডায়রিয়া রোগের জন্য দায়ী (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর ২০১৭)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়স বিভাগ ২০১৪ সনে পোল্ট্রি মুরগির মগজে ৭৯৯ পিপিএম, মাংসে ৩৪৪ পিপিএম, চামড়ায় ৫৫৭ পিপিএম, কলিজায় ৫৭০ পিপিএম এবং হাড়ে ১৯৯০ পিপিএম ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি আবিষ্কার করেন (সূত্র: ইন্টারন্যাশনাল জার্ণাল অব সিভিল, স্ট্রাকচারাল, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট, আগষ্ট ২০১৪)। মানবদেহে এই ভারী ধাতু ক্রোমিয়ামের সহনীয় মাত্রা হলো প্রতিদিন ২৫ পিপিএম। একই সনের নভেম্বরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি ইউনিট মাছের জন্য তৈরি খাদ্য নিয়ে একটি গবেষণা করে দেখেছে, প্রতি কেজি মাছের খাবারে ৪৯৭১.১৫ পিপিএম এবং মুরগির খাবারে ৪,২০৫.৭০ পিপিএম ক্রোমিয়াম আছে (সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪)।
দানাজাতীয় খাদ্য থেকে শুরু করে প্রাণিজ আমিষ বা শাকসব্জি কী ফলমূল কোনো খাবারই আজ নিরাপদ নয়। স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকিমুক্ত নয়। তাহলে এখন খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদেরতো একেবারে প্রাথমিক শর্তটা পূরণ করা দরকার। নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত ও ভেজালমুক্ত খাদ্য উৎপাদন, ব্যবহার, বন্টন ও গ্রহণ। আমরা খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্য উৎপাদনে বরাদ্দ বাড়ানোর ক্ষেত্রে এ বছর বিশ্ব খাদ্য দিবসে স্পষ্ট করে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের কথা বলছি। কীটনাশকসহ সকল ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ স্বাস্থ্যকর বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদনে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি। খাদ্য কেবলমাত্র ক্ষুধা নিবারণ করে না, এটি শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটায়। খাদ্যের রয়েছে ভৌগোলিক, প্রতিবেশগত এবং সাংস্কৃতিক নানা ব্যঞ্জনা। খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদের এসব বৈচিত্র্য ও ব্যাঞ্জনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। খাদ্যের সাথে জড়িত সকল প্রাণ ও প্রজাতির আন্ত:নির্ভরশীল সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে হবে। সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য একটি গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী সমাজ ব্যবস্থার পূর্বশর্ত। এই শর্ত পূরণে রাষ্ট্র, জনগণ, গণমাধ্যমসহ সকলকেই একযোগে কাজ করতে হবে। নিরাপদ খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই, কোনো ধরণের জোড়াতালি দিয়েও এর কোনো চমক তৈরি করা যায় না। নিরাপদ খাদ্য সমাজের সকলের প্রতি সকলের শ্রদ্ধাশীল সম্পর্ককে জাগ্রত করে এবং বিকশিত করে। আসুন আমরা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সকলেই নিজেদের দায়িত্বশীলতাকে আরো প্রসারিত করি।