হায়রে আমার ঢাকা শহর!
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল:
আমাদের প্রিয় শহর তিলোত্তমা ঢাকা। অনেকেই ঢাকাকে অনেক নামে অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু ঢাকা শহর প্রতিদিন বাস অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে এটি রাস্তা ঘাটে সকল ক্ষেত্রে চলতেই শোনা যায়। আপনি যখন কোথাও যেতে চাইবেন প্রথমেই আপনাকে ভাবতে হবে কোন পথে যাবেন, কিভাবে যাবেন, কত সময় লাগবে, সময় মতো পৌছতে পারবেন কিনা, রাস্তা বন্ধ কিনা, ভিআইপি পারাপার আছে কিনা, রাস্তায় কোন ঝামেলায় পড়বেন কিনা এমন হাজারো প্রশ্ন মনে খেলা করবে। এছাড়া ভাঙা রাস্তা, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, জ্যাম’র কথাতো ভাবতেই হবে।
যেমন গতকাল কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তা আটকে আন্দোলন করলো আর যার ফলশ্রুতিতে মিরপুর রোডসহ বিভিন্ন রাস্তায় ছড়িয়ে পড়লো ভয়াবহ জ্যাম। আমি একটি মিটিং এ যাবার জন্য বের হয়েছিলাম সেখানে পৌছাতে লাগলো প্রায় দুই ঘণ্টা সময়। তাই মিটিং এ পৌছালাম প্রায় সকলের শেষে। এভাবে প্রতিদিনই আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সময় আর আমরা হয়ে পড়ছি জিম্মি। এখন প্রশ্ন হলো এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় কি? কিভাবে আমরা একটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবো?
আমরা একটু দেখার চেষ্টা করি এসবের মূল কারণগুলো কি কি?
১. আমাদের প্রচলিত আইন ও তার প্রতি জনগণের আস্থার অভাব একটি বড় সংকট তৈরি করেছে। জাতি হিসেবেই আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা অনেক কম। এটি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনেই প্রতিয়মান হয়। রাস্তার একটি আইন রয়েছে। আর তা হলো কে কখন কিভাবে যাবে তার নির্দেশনা কিন্তু তা আমরা মানতে রাজি নই। রাস্তায় বের হলেই আমাদের মধ্যে একটি ভয়াবহ অস্থিরতা কাজ করে আর তা হলো কে কত দ্রুত যেতে পারবো আর কে কার আগে যেতে পারবো। আর এর ফলে আমরা সকল আইন, নিয়ম ভঙ্গ করেই এগিয়ে যেতে চাই। ফুটপাত হলো পথচারীদের হাঁটার জন্য কিন্তু আমরা দেখতে চাই ফুলপাতে সচরাচর মোটরসাইকেল উঠে আসে। হাইকোর্ট এর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এখনো ফুটপাতে প্রতিদিন হাজারো মোটরসাইকেল উঠে আসে আর পথচারিদের সমস্যায় পড়তে হয়। গাড়ির লেন মেনে কেউ গাড়ি চালাতে আমাদের দেশের মানুষ অভ্যস্ত না। তারা যখন যেভাবে পারে গাড়ি চালাতে থাকে। তাই গাড়িগুলো রাস্তায় চলে খুব বিশৃঙ্খলভাবে। এতেই সৃষ্টি হয় জ্যাম আর ভোগান্তির।
২. একজন যখন আইন ভঙ্গ করে তার দেখাদেখি আরেকজনও একই পন্থা অবলম্বন করে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে উচিত ছিল কেউ আইন ভঙ্গ করলে আর মানুষ তাকে বাধা দেবে। এই কারণে এখানে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে ট্রাফিক জ্যাম আর ভোগান্তি। এই দেখে অন্যায় শেখার প্রবণতা আমাদের আরো বেড়ে গেছে।
৩. আইন ভঙ্গ করলে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে যে ধরণের শাস্তির বিধান ও ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের দেশে তা অনেকটা শিথিল। আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নাই। তাইতো যে কেউ অন্যায় করতে দ্বিধা বোধ করে না। অন্যদিকে ক্ষমতাবানরা তাদের ক্ষমতার সবচেয়ে অপব্যবহার করে থাকেন রাস্তায়। মন্ত্রী, এমপি, বিচারক, পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিকসহ সকলেই রাস্তায় কোন নিয়মকানুন মেনে চলেন না। যদিও সম্প্রতি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কিছু উদ্যোগ লক্ষ্য করে গেছে। এটি মানুষের কাছেও খুব নন্দিত হয়েছে। মানুষ এই উল্টোপথে ভিআইপিদের যাতাযাতে পুলিশের ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়েছেন। এই ধরণের উদ্যোগ নিতে থাকলে মানুষ অনেক সচেতন হবে বলে অনেকেই মনে করেন।
৪. গণসচেতনতার অভাব একটি বড় কারণ ঢাকা শহরের জন্য। একটি শহরের মানুষদের যে ধরণের সচেতনতা প্রয়োজন আমাদের রাজধানী শহরে তা দেখা যায়না। সেটা ট্রাফিক আইন মানার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায় এমনকি পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। প্রায় দুই কোটির অধিক জনবসতির এই শহরে মানুষ একটি বিশৃঙ্খল আচরণ প্রতিমূহুর্তে করে থাকে। তাইতো কোন ধরণের নিয়মকানুনের তোয়াক্কা তারা করেন না। ফলে সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা।
৫. প্রতিদিন ঢাকা শহরে অসংখ্য ব্যক্তিগত গাড়ি নতুনভাবে রাস্তায় নামে। কিন্তু সে অনুপাতে গণপরিবহনের সংখ্যা কম। প্রতিদিন রাস্তায় যে পরিমাণ ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে তার অধিকাংশই থাকে খালি অবস্থায়। একটি বাসে করে যত মানুষ প্রতিদিন চলাফেলা করতে পারে, একটি প্রাইভেট কারে তা সম্ভব না । তাইতো প্রাইভেট কার আমাদের পরিবহন ব্যবস্থায় একটি বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত হয়। সেই জায়গা থেকে গণপরিবহনের প্রয়োজনীয়তাটি খুবই জরুরি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় বাহন হলো গণ পরিবহন। কিন্তু আমাদের দেশে গণপরিবহন হলো আরেক ভোগান্তিরই নাম। এই কারণে গণপরিবহন বৃদ্ধি করা একটি জনপ্রিয় দাবি।
৬.যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং যানজটের একটি প্রধান কারণ। ঢাকা শহরের অধিকাংশ রাস্তায় আমরা দেখি অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয় আর তার দরুণ রাস্তায় গাড়ি ও পথচারিদের যাতায়াতে দেখা দেয় ভয়াবহ সমস্যার। মার্কেট আছে কিন্তু তার নিজস্ব কোন পার্কিং ব্যবস্থা নেই। যার ফলে দেখা যায় রাস্তায় গাড়ি রাখা আছে অধিকাংশ মার্কেটের সামনে। এর ফলে দেখা দেয় জানজটের। কিন্তু এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে তেমন একটা উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না।
৭. ভিআইপি যাতায়াতের ফলে ঢাকা শহরের মতো এতো যানজট পৃথিবীর কোথাও হয় কিনা তা বলা মুশকিল। ভিআইপি যাতায়াতের নামে প্রতিদিন মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এই ব্যবস্থা যতদিন বলবৎ থাকবে ততদিন ঢাকা শহর থেকে যানজট দূর করা কঠিন। এই ভিআইপি পদ্ধতির কারণে সকলের মধ্যে নিয়ম ভাঙ্গার প্রবণতাটিও আরো বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় দেখা যায় সাধারণ মানুষ এই উদাহরণ টেনে নিয়ম ভঙ্গ করতে চায়।
এই সার্বিক অবস্থায় আমাদের সামনে কি করণীয় এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা’র) চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সাথে। তিনি বলেন, “ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য আর যানজটমুক্ত করতে হলে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণের আর কোন বিকল্প নেই। সকল ইনভেস্টমেন্টগুলো হচ্ছে ঢাকায়, কাজের সকল জায়গা হচ্ছে ঢাকায়, অন্য শহরগুলোতে নেই মানুষের কর্মসংস্থানের তেমন কোন ব্যবস্থা, সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও পরিসেবা পাওয়া যায় ঢাকায় তাই মানুষের জনাধিক্য বেড়েই চলছে আর সেজন্যই ঢাকা দিনদিন বাস অনুপযোগী হচ্ছে।” তিনি আরো বলেন, “ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে স্টেশন কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা জরুরি। গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলার সাথে ট্রেনকেন্দ্রীয় খুবই তড়িৎ যোগাযোগ সৃষ্টি করা গেলে ঢাকার উপর চাপ কমতে পারে। এছাড়া প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্র্রণ করে গণ পরিবহন বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।”
ঢাকার অধিকাংশ মানুষ পায়ে হেঁটে চলা ফেরা করে তাই ফুটপাতগুলো হাঁটার উপযোগী এবং সাইকেল ও রিকসার জন্য আলাদা লেন বানানো জরুরি বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। এছাড়া প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগও যানজট কমাতে সাহায্য করবে বলে তিনি জানান।
প্রাণের শহর ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে তাই জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টাই কেবল এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারে।