হাওরবাসীর অভিযোজন
নেত্রকোনা থেকে সুয়েল রানা
নেত্রকোনা জেলার দশটি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি উপজেলায় হাওরের রয়েছে। পাঁচটি হাওরের মধ্যে কলমাকান্দা, মদন, কেন্দুয়া ও মহোনগঞ্জ এই চারটি উপজেলার আংশিক হাওর এবং আংশিক সমতল ভূমি। খালিয়াজুড়ি উপজেলার পুরোটাই হাওর অধ্যুষিত। হাওরাঞ্চল এলাকাভেদে বছরের ৫-৭ মাস সময় জলাবদ্ধ থাকে। কৃষি ফসল বলতে একমাত্র বোরো ধানের চাষ হয়। হাওরের কৃষকরা একমাত্র বোরো ধানের উপর নির্ভরশীল। এক মৌসুম বোরো ধান ঘরে তুলতে সক্ষম হলে হাওরবাসীর কয়েক বছরের খোরাক হয়ে যায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে প্রায়শই হাওরের বোরো ফসল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন হাওরবাসীর দুর্যোগের সীমা থাকেনা। দুর্যোগে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলে হাওরবাসীরা দেশের অন্যত্র গিয়ে কাজ করে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
বারসিক ২০১৮ সাল থেকে মদন উপজেলার মদন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে হাওরের জনগোষ্ঠীর সাথে কাজ আরম্ভ করে। মদন উপজেলায় কাজের শুরু থেকে বারসিক হাওরের কৃষকদেরকে হাওরের পরিবেশ উন্নয়নে পানি সহনশীল গাছের বনায়ন করা এবং কৃষি ক্ষেত্রে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে একক ফসল শুধু বোরো ধান চাষ না করে, ধানের পাশাপাশি হাওর উপযোগি অন্যান্য শস্য ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করে আসছে। হাওর এলাকা উপযোগি শস্য ফসলের জাত নির্বাচনে বারসিক হাওরের কৃষকদের নেতৃত্বে শস্য ফসলের প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা করে এলাকা উপযোগি শস্য ফসলের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। প্রথম বছরে প্রায়োগিক গবেষণা থেকে কৃষকরা বেশকিছু শস্য ফসলের জাত নির্বাচন করে দ্বিতীয় বছরের রবি মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিমাণ জমিতে চাষ করে। নির্বাচিত জাতগুলোর মধ্যে-সরিষা, গম, ভূট্টা, ধনিয়া, পাট মসুর ডাল। ২০২০-২০২১ রবি ও খরিপ মৌসুমে মদন ও গোবিন্দশ্রী হাওরের কৃষকরা আরও ব্যাপক পরিসরে নির্বাচিত ফসলগুলো চাষ করেছেন। হাওর অধ্যুষিত গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন ও হাওরঘেঁষা মদন ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের ৪২ জন কৃষক ৩.১৮ একর জমিতে সরিষা, ৪টি গ্রামের ৯ জন কৃষক ৬.১ একর জমিতে গম, ৪টি গ্রামের ১২ জন কৃষক ১.২ একর জমিতে ভূট্টা, ১২টি গ্রামের ২৬ জন কৃষক ১.৬ একর জমিতে ধনিয়া, ৪টি গ্রামের ৯ জন কৃষক ১.২ একর জমিতে মসুর ডাল এবং ১৮টি গ্রামের (পাড়া) ৭৬ জন কৃষক ৫১ একর জমিতে দুই জাতের তোষা ও মেছতা) পাট চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে কৃষকরা সরিষা, ধনিয়া ও মসুর ডাল ফসল সংগ্রহ করেছেন এবং ভালো ফলন পেয়েছেন। গমের ভালো ফলন আশানুরূপ হয়নি। বাবুই পাখি ক্ষেতেই গম খেয়ে ফেলে। তবে ভূট্টার ফলন ভালো হয়েছে বলে কৃষকরা জানায়।
কৃষকসহ হাওরাঞ্চলে বসবাসকারী সকল শ্রেণী ও পেশার জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সবজি ও মসলা জাতীয় খাদ্যের জন্য বাজারের উপর নির্ভরশীল। হাওরের বাজারগুলো আবার এসব পণ্যের জন্য অন্যান্য সমতল এলাকার উপর নির্ভরশীল। হাওরে সবজি ও মসলা ফসল হয় না বলে চাষ করেন না। হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ বসতভিটাগুলো অত্যন্ত সংকীর্ণ হওয়ায় মাঁচা করে সবজি চাষ করা যায় না। অন্যদিকে বন্যার পানিতে ঘরের উঠানে পানি উঠে যাওয়ায় সবজি গাছগুলো পানিতে নষ্ট হওয়ায় কৃষকরা সবজি চাষে আগ্রহী হয় না। শীত মৌসুমে হাওরে সামান্য পরিমাণে সবজি চাষ হলেও বর্ষা মৌসুমে বা খরিপ মৌসুমে সবজি চাষ হয়না বললেই চলে। বর্ষা মৌসুমে হাওরবাসী সম্পূর্ণই বাইরের সবজির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বারসিক কার্যক্রমের শুরু থেকে বসতভিটার সামান্য পতিত জায়গাগুলোতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি চাষের জন্য হাওরের কৃষকদেরকে সবজি বীজ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে আসছে। বারসিক’র বীজ সহায়তা পেয়ে হাওরের কৃষক-কৃষাণীরা তাদের সামান্য বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি যেমন-লাউ, মিষ্টিকুমড়া, শিম, বরবটি, পেঁপে, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানীয় ও লোকায়ত পদ্ধতিতে চাষ করছেন।
প্রকল্পের তৃতীয় বছরের শেষ ভাগে দেখা যায়, মদন ও গোবিন্দশ্রী হাওরে বৈচিত্র্যময় সবজি ও শস্য ফসলের চাষ হয়েছে। কৃষকরা স্বল্প মেয়াদী সবজি জমিতে চাষ করছেন, আবার দীর্ঘ মেয়াদী সবজি (শিম, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, করলা, চালকুমড়া, পুঁইশাক, বারমাসি মরিচ ইত্যাদি) বস্তা পদ্ধতিতে মাঁচায়, সাধারণ মাঁচায় এবং টাওয়ার পদ্ধতির মাঁচায় এবং সামান্য পরিমাণে ভাসমান বেডে চাষ করছেন। কেউ কেউ আবার বর্ষা মৌসুমে টাওয়ার পদ্ধতির মাঁচায় এবং বস্তা পদ্ধতিতে মাঁচায় সবজি চাষ করে বাজারে বিক্রি করছেন। এসব স্থানীয় ও লোকায়ত পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে হাওরের কৃষকরা বর্ষা মৌসুমে পরিবারের চাহিদা অনেকটা পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছেন। কৃষকরা হাওরের দু’টি ইউনিয়নে দু’টি ‘হাওর বীজঘর’ গড়ে তুলে বৈচিত্র্যময় সবজি ও শস্য ফসলের বীজ সংরক্ষণ ও পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করায় কৃষকদের জন্য বীজের সহজলভ্যাতা সৃষ্টি হয়েছে।
হাওরাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অন্যতম দুর্যোগ হল আফাল বা ঢেউ। হাওরের বাড়িগুলো মূলত: মাটি ভরে উঁচু ভিটার উপর তৈরি করা হয়। বাতাসের ফলে হাওরে বড় বড় ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। বড় বড় ঢেউ হাওরাঞ্চলের বসতভিটায় আঁচড়ে পড়ে প্রতিবছরই ভিটের মাটি ভেঙ্গে পানিতে ভেসে যায়। ফলে প্রতিবছরই হাওরবাসীদেরকে ভিটায় মাটি ভরতে হয়। বসতভিটার মাটি আফালের ভাঙন থেকে রক্ষায় হাওর জনগোষ্ঠী বিভিন্ন স্থানীয় ও লোকায় কৌশল ব্যবহার করে থাকেন। বসতভিটার ভাঙন রোধে তারা উজাউড়ি বা ঢোল কলমী, হিজল ও করচ গাছ, মুর্ত্তা, বেন্নাচুবা ও কুচুরি পানা (জারমুনি) দিয়ে লাগিয়ে বেস্টুনী গড়ে তোলেন। হাওরের যে দিক থেকে আফাল এসে বসতভিটায় আঁচড়ে পড়ে, সেদিকে উজাউড়ি বা ঢোল কলমী গাছ ঘন করে রোপণ করে বাঁশ বা গাছের ছোট ছোট ও লম্বা ডাল দিয়ে বেঁধে দেন। উজাউড়ি বড় হলে তা যেমন বাতাসকে প্রতিহত করে তেমনি বর্ষা মৌসুমে অফাল এসে উজাউড়ি বেড়ায় আঁচড়ে পড়ে দূর্বল হয়ে পড়ায় ভিটায় সরাসরি আঘাত করে ভাংতে পারেনা। অনেকে আবার বাড়ির বা গ্রামের যে দিক থেকে আফালের আঘাত বেশি হয় সেদিকে করচ গাছ ঘন করে রোপণ করে। এর ফলে ঢেউয়ের আঘাত এবং ঝড় করচ গাছে ধাক্কা খেয়ে প্রতিহত হয় এবং বসতভিটা ও গ্রামের তেমন ক্ষতি করতে পারেনা। অনেকে বন্যার পানির ¯্রােত থেকে বসতভিটা ও রাস্তার সুরক্ষায় পানির সাথে ভেসে আসা (কুচুরি পানা)জার্মুনী পানা ধরে বসভিটার চারিপাশে জমা করে প্রাচীর তৈরী করে রাখেন। এর ফলে পানির ¯্রােত সরাসরি বসতভিটা বা রাস্তায় আঘাত করে ক্ষতি করতে পারেনা।
হাওরের জনগোষ্ঠী রবি মৌসুমে সবজি ক্ষেতে বিশেষভাবে সেচ বিহীন গোল আলু চাষ করতে মাটিতে সরাসরি সূর্যের আলো পড়া রোধে ছাউনী বা মালচিং হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। কেননা বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর হাওরাঞ্চলে পানির সংকট দেখা দেয়। অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় মানুষের গোসল ও গবাদী পশুর গোসল এবং পানের পানির ব্যাপক সংকট দেখা দেয়। জামর্ৃুনী পানা দিয়ে আলুর জমি ঢেকে দেয়ায় মাটি দীর্ঘদিন রসালো থাকে এবং তাতেই আলুর চাষ কয়ে যায়। হাওরের কৃষকরা কেঁচো কম্পোস্ট উৎপান করে সবজি জাতীয় ফসল জৈব উপায়ে চাষ করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছে। হাওরে প্রতিবছর মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাত দুর্যোগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ প্রাণী মারা যায়। বজ্রপাত মোকাবেলায় হাওরের জনগোষ্ঠী বসতভিটা, গ্রামের রাস্তার পাশে এবং ফাঁকা জায়গায় তাল বীজ রোপণ করেছে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের সাথে খাপ খাইয়ে চলার সচেতনতামূলক বাণী সম্বলিত ৫০টি বিলবোর্ড বারসিক’র সহযোগিতায় জনগোষ্ঠী দু’টি ইউনিয়নের বিভিন্ন জনসমাগম স্থানে স্থাপন করেছেন। খরা মোকাবেলায় কৃষকরা ভূগর্ভস্থ পানির কম ব্যবহার করে ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহার করছে (যেসব এলাকায় ছড়া, নদী ও জলাশয় রয়েছে)। হাওরের জনগোষ্ঠী পানি সহনশীল ও হাওর এলাকা উপযোগি সবজি, ফল ও কাঠ জাতীয় গাছের চারা সহজলভ্যকরণে ব্যক্তি উদ্যোগে দু’টি নার্সারি স্থাপন করে বৈচিত্র্যময় চারা উৎপাদন করছেন। ফলে এলাকার পরিবেশ ইন্নয়নে জনগোষ্ঠী সহজেই গাছের চারা সংগ্রহ করে রোপণ করছেন।
হাওরাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দুর্যোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষভাবে কৃষি ক্ষেত্রে খরা, আগাম বন্যা, ফসলে রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ, ধানের চিটার হার বৃদ্ধি ও কোল্ড ইঞ্জুরি হাওরের নিত্যসঙ্গী। কৃষকরা খরা ও আগাম বন্যার সাথে খাপ খাইয়ে আগাম ধানের জাত একমাস আগে চাষ করছেন। অনেকে ধানের জমিতে পার্চিং দিয়ে পাখি বসার ব্যবস্থা করে এবং সবজির জমিতে সেক্সফেরোম্যান ফাঁদ ব্যবহার করে ও বালাইনাশক তৈরি করে ব্যবহার করে বালাই দমন করছেন। কোল্ড ইঞ্জুরির সাথে অভিযোজনে তারা ধানের পরিবর্তে শীত সহনশীল ফসল যেমন-সরিষা, মসুর, গম, ভূট্টা ইত্যাদি ফসল চাষ করছেন। ধানের বিকল্প ফসল চাষ করায় সেসব ফসলে তেমন সেচের প্রয়োজন হয়না ফলে উৎপাদন খরচ কম হচ্ছে এবং হাওরের কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবেলা ও দুর্যোগের সাথে অভিযোজন করে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে এবং কৃষি ফসল ফলাতে সক্ষম হচ্ছেন।