কুমার পাড়ায় নারীদের বৈশাখী উৎসব
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
নেত্রকোনা আমতলা গ্রামে কুমার পাড়ায় নারীদের তৈরি মাটির পণ্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বৈশাখী উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবে কুমার পাড়ায় ২৭ জন নারী নিজেদের তৈরির মাটির উপকরণ স্টল নিয়ে গ্রামের ভিতরে সিতা রানীর বাড়ির উঠানে একত্র হয়। সকাল থেকে উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। নারীরা নিজেদের তৈরি মাটির উপকরণ ঢাকিতে ভরে মাথায় নিয়ে উৎসবের স্থানে জড়ো হন। কিছুক্ষণের মধ্যই নানা রঙের রাঙানো মাটির উপকরণ উঠানটি রঙিন করে তুলে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মায়ের সাথে এসে যুক্ত হয় উৎসবে। গ্রামে কিশোরীরা উৎসবে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে বস্ত। জড়ো হয় গ্রামের প্রবীণ নারীরা। রৌদে কাদায় মাখামাখি করে যে নারীদের দিন চলে যায়, আজ তারা প্রথমবারের মতো নিজের পরম যতেœ গড়া উপকরণগুলো নিজেই সকলের সামনে নিয়ে আসতে পেরে আনন্দের পাশাপাশি তাদের চোখে মুখে এক ধরনের গর্ভের আভা লক্ষ্য করা গেছে।
মাটির সাথে জড়িত পরিবেশবান্ধব উপকরণ তৈরিকারী সুবিধা বঞ্চিত নারীদের পণ্য উৎপাদনে আগ্রহ সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের সৃষ্টি কর্মকে আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে আমতলা কুমার নারী সংগঠনের উদ্যোগে বারসিকের সহায়তায় এ আয়োজন করা হয়। মেলার শুভ উদ্বোধন করেন গ্রামের প্রবীণ নারী সিতা রানী পাল। বারসিক’র পক্ষ থেকে মেলায় অংশগ্রহণ করেন বারসিক কর্মকর্তা অহিদুর রহমান, শংকর ¤্রং, খাদিজা আক্তার লিটা প্রমুখ।
অংশগ্রহণকারী কুমার নারীরা মেলায় বসে নিজেদের পণ্য বিক্রয় কমে যাওয়া, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, পেশা টিকিয়ে রাখার নানা সুখ, দুঃখগুলো তুলে ধরেন সকলের সামনে। বারসিক কর্মকর্তা অহিদুর রহমান তাদের জীবনমান উন্নয়নে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সাথে যুক্ততার প্রয়োজনীয় তা নিয়ে আলোচনা করেন। বারসিক কর্মকর্তা শংকর ¤্রং কুমার নারীদের উপকরণ বাজার চাহিদার সাথে তৈরীর প্রয়োজনীয়তা ও মান উন্নয়নে করণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন এবং সার্বিকভাবে সহায়তা করার কথা বলেন।
উৎসবের শেষ পর্যায়ে স্টলের প্রতিটি নারীর হাতে পরিবেশবান্ধব কৃষি উপকরণ যা তাদের জীবনযাপন ও পণ্য বাজারজাতকরণে সহায়তা করবে তা পরুষ্কার হিসেবে তুলে দেন বারসিক কর্মকর্তাগণ। এমনি না সুখ দুঃখে গল্পের মধ্য দিয়ে বৈশাখীর মেলার কিছুটা আনন্দ ছড়ি দিয়ে উৎসবের সমাপ্ত করা হয়।
আমতলা গ্রামে প্রতিবছর বৈশাখী মেলা বসে। সেখানে মাটির উপকরণগুলো কুমার পাড়া থেকে যায়। কিন্তু সে মেলায় কোন নারীদের অংশগ্রহণ থাকে না। নারীদের দায়িত্ব শুধু তৈরি করে দেওয়া মেলার আগ মূর্হুত পর্যন্ত প্রতিটি পণ্য পরম যতেœ আগলে রাখেন নারীরা কিন্তু মেলার অংশগ্রহণের আনন্দ থেকে বঞ্চিত কুমার নারীরা। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীকে সামাজিক কাজ থেকে বঞ্চিত রাখার পাশাপাশি আর্থিকভাবে স¦াবলম্বী করে তুলা থেকে দুরে ঠেলে দেওয়ার একটি বড় উদারণ গ্রামীণ মেলায় শুরু পুরুষদের অংশগ্রহণ।
চৈত্রের শুরুতে নেত্রকোনা প্রায় প্রতিটি গ্রমে চৈত্রে সংক্রান্তি মেলা, বারণি, সাথে প্রস্তুতি চলতে থাকে বৈশাখী মেলার। প্রতিটি মেলাকে আকর্ষণীয় করে তুলে মেলা আসা নানা রঙের রাঙানো মাটির খেলনা, নিত্য প্রয়োজনীয় উপকরণ। পুুরুষরা মাটির উপরণ নিয়ে মেলায় বিক্রয় করলেও খেলনাগুলো তৈরী হয় নারীদের হাত ধরে।
নেত্রকোনা অধিকাংশ মেলায় মাটির খেলনাগুলো আসে আমতলা কুমার পাড়া থেকে। কুমার পাড়ার নারীরা চৈত্রের শুরুতে মাটি দিয়ে খেলনাগুলো তৈরির কাজ শুরু করে। চৈত্র মেলার আগে দিন রঙ করা হয় । মানুষ, পশুপাখি, মাছ, গাছপালা সকল কিছু নিজেদের হাতে যাদুতে ফুটিয়ে তুলে কাদা মাটির মাখামাখি করে। বাংলার প্রাণ প্রকৃতির সাথে জীবনচিত্র ফুটে উঠে প্রতিটি খেলনা বা উপকরণে। মাটির তৈরি ছোট ছোট পালকি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যানবাহন মুক্ত, গাছপালা ছায়ার ঘেরা গ্রামের মেঠো পথে চারজন বেহারা কাঁধে করে হুম না হুম শব্দ করে নতুন বউ নিয়ে হেটে যাওয়ার চিত্র। মাটির কলস, হাংকি, মাটির গ্লাস যা মানব দেহের নিরাপদ পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি ব্যয়বহুল অস্বাস্থ্যকর ফ্রিজ ও বাজারের বোতল থেকে বাঁচার কৌশলগুলো আঙ্গুল দিয়ে দেখি দেয়।
বাংলাদেশে গ্রাম বাংলার প্রতিটি মেলা আমাদের সংস্কৃতির আমাদের ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে। তাই আমাদের এ মেলাগুলো টিকিয়ে রাখতে মেলার সাথে জড়িত কুমার পরিবারগুলোর দিকে সুনজার দেওয়া প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানগুলো। পণ্য বাজারজাতকরণ, উপযুক্ত মূল্য, প্রচারণা, আর্থিকভাবে সহায়তার পাশাপাশি বর্তমান বাজার চাহিদার সাথে মিল রেখে পরিবেশবান্ধব মাটির উপকণ তৈরির প্রশিক্ষণে সার্বিকভাবে সহায়তা প্রয়োজন। তবে সম্ভব আমাদের এ প্রান্তিক কুমার পরিবারগুলোকে নিজস্ব পেশায় টিকিয়ে রাখা। আসুন আমরা সুস্থ, নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য প্লাষ্টিক বর্জন করি, মাটির নিরাপদ পণ্যগুলো তুলে দিই আমাদের আগামী প্রজন্মের হাতে।