ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এ মৎস্য সম্পদের ক্ষতি
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে রামকৃষ্ণ জোয়ারদার
৯ই নভেম্বর রাতে আঘাত আনে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। দেশের ১৬টি উপকূলীয় জেলায় এই ঝড়ে কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। সুন্দরবন আবারও উপকূলবাসীকে বড় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। সুন্দরবনের কারণে আঘাত কম হলেও শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এলাকার সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ সময় অধিকাংশ মৎস্য ঘের পানিতে তলিয়ে একাকার হয়েছে। সুপেয় পানির আঁধার, বাথরুম, বিদ্যুৎ লাইন, কৃষি ফসল, বীজ বৈচিত্র্য, বসতঘর, হাঁস-মুরগি, শিশুদের শিক্ষা উপকরণ, আসবাসপত্র, নদীর বাঁধসহ বনায়নের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে উপকূলবর্তী মানুষের আয়ের এবং জীবনধারণে সবচেয়ে বড় যে উৎস, সেই সুপেয় পানির পুকুর ও মাছের ঘেরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বিগত সময়ের ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার পরে সাতক্ষীরা জেলা শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহযোগিতায় এলাকার বিভিন্ন স্থানের লবণ পানি অপসারণ করে পুকুর পুনঃখনন করে মাছ চাষ, সুপেয় পানি ও ফসলের কাজে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এসময়ে এলাকার বিভিন্ন স্থানের পুকুর ও ঘের ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে তছনছ হয়েছে। বুলবুল পরবর্তী সময়ে স্থানীয় এলাকায় মাঠ পর্যবেক্ষণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিকটে তাদের সমস্যার কথা জানতে চাইলে, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে আড়পাংগাশিয়া গ্রামে প্রভাষ মিস্ত্রী বলেন, “আমাদের এক বিঘা একটা বড় পুকুর ছিল। এই পুকুরে জল আমরা সারাবছর পিএসএফ ফিল্টারের মাধ্যমে জল খেতাম ও রান্নার কাজে ব্যবহার করতাম। এই পুকুরে বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় প্রজাতির মাছ ছিল, যেমন রুই, কাতলা, মৃগেল, পুঁটি, টেংরা, তড়া, সিলভারকার্প, বাটা, গ্রাসকার্প, মরখুল্ল ইত্যাদি মাছ। তবে বুলবুলের আঘাতে পুকুর পাড়ের গাছ সব পড়ে গেছে। বিভিন্ন গাছ, গাছের পাতা ও ডাল পড়ার কারণে ঝড়ের পরের দিন থেকে মাছ মরা শুরু হয়েছে। পুকুরের জল কালো হয়ে দূর্গন্ধ হয়েছে।”
বুড়িগোয়ালিনী গ্রামে কৌশল্যা মুন্ডা বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে আমাদের পুকুরের জল নষ্ট হয়ে গেছে মাছ মারা যাচ্ছে। বিভিন্ন গাছ, গাছের পাতা ও ডাল পড়ার কারণে ঝড়ের পরের দিন থেকে মাছ মরা শুরু হয়েছে। পুকুরের জল কালো হয়ে দূর্গন্ধ হয়েছে। এই পুকুরের জল আমরা খাওয়া, রান্নার কাজে ও গোসলের কাজে ব্যবহার করতে পারছি না। এ পানির সমস্যা কাটানোর জন্য আমাদেরকে বর্ষা মৌসূম পর্যন্ত সেটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। আমাদের জলের জন্য অনেক অসুবিধা হচ্ছে।” শনিবার রাত্রে এই ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পুকুর ও ঘেরের মাছের। চিংড়ি ঘের চাষি বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে আবাদ চন্ডিপুর গ্রামে অসিম সরকার বলেন, “আমার নিজের জমি না থাকায় আমি অন্যের জমি হারী (লিজ) নিয়ে চিংড়ি ঘের করছি ২২ বিঘা জমিতে। প্রতি (১বিঘা জমি) বিঘা জমি ১০,০০০ টাকা করে হারী বছরে নিয়ে চিংড়ি ঘের করছি। জমির মালিককে ৩/৫ বছরে জমির হারী আগে দিতে হয়েছে। আমার ঘেরে বাগদা চিংডি, হরিণা চিংডি, চামনা চিংডি, রসনা চিংড়ি, তেলাপোয়া, পায়রা, পার্শে, টেংরা, ভেটকি (কোরাল), ভাঙন, গুলে ইত্যাদি অনেক প্রজাতির মাছ ছিল। বর্ষার সময় যখন লবণ কমে যায় তখন আমি সাদা মাছ হিসাবে কালবোশ, মৃগেল, জাপানী পুঁটি, টেবলেট মাছ ঘেরে ছেড়ে ছিলাম।” ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত আনার আগে আমি ঘের থেকে প্রতিদিন বাগদা চিংড়ি ৫/৬ কেজি ও অন্য সাদা মাছসহ চিংড়ি মাছ বিক্রয় করতাম। বাগদা চিংড়ি ৫০০-৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় করেছি, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আগে আমি ১ লক্ষ্য ২০ হাজার টাকা বিক্রয় করেছি। বছরে প্রায় এই ২২ বিঘা জমিতে প্রায় ৪-৫ লক্ষ টাকার আয় হতো। ঘূর্নিঝড় বুলবুলের পরে বর্তমানে ঘের থেকে আমি এখন ৪০০- ৫০০ গ্রাম মাছ বিক্রয় করছি। ঘেরের রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়া বৃষ্টির পানি ও নদীর জোয়ারের পানিতে সব মাছ স্রােতে চলে গেছে অন্যেও ঘেরে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ঝড় আমাদেরকে শেষ করে দিয়েছে। এখন আর ঘেরে কোন মাছ নেই।”
এরকম প্রায় ২০০-২৫০ ঘের আছে তাদেরও এরকম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায় যে,
সব মিলিযে কালিগঞ্জ, আশাশুনি, শ্যামনগর উপজেলায় ৫,৭১৯হেক্টর জমিতে চাষ করা ৫০১৭টি চিংড়ি ঘেরের সাদা মাছের ঘের ও পুকুর ভেসে গেছে। এতে ১৪ মেট্্িরক টন মাছ ভেসে গেছে, যাতে ক্ষতি হয়েছে ৪৭ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে ঘেরের মাছ। (তথ্য প্রথম আলো ১২/১১/১৯)।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে উপকুলীয় এলাকায় সুপেয় পানির যেমন সমস্যা তৈরি হয়েছে তেমনি চিংড়ি চাষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়েছে। তারপরেও স্থানীয়রা নানান ধরনের উদ্যোগ চলমান রেখেছে। সাথে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় রক্ষা পেতে পারে উপকূলীয় সুপেয় পানি ও চিংড়ি ঘের।