সাদা বক বাড়িয়ে তুলছে চলনবিলের সৌন্দর্য
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
খাবারের সন্ধানে বিল নদী জলাশয়ে আসে/ঝাঁকে ঝাঁকে কানি সাদা বক/কীট পতঙ্গ পুটি মাছে/লোভাতুর চোখ করে চক চক। উঁচিয়ে দীর্ঘ গলা মত্ত যখন/শিকারের নেশায় ফেলে পা/জানে না পরবে কখন কার পাতা ফাঁদে/অজানা শংকা; ভয়ে ছম ছমে গা। খাবার খেতে গিয়ে/নিজে হয় অন্যের খাবার/তাতে যায় আসে/ কিই বা কার! উড়ে যায় সাঝ বেলা ডানা ঝাঁপটে আকাশ নীলিমায়/রেখে যায় চিহ্ন ঝরে পরে পালক/নদী বিল জলাশয়ে/অবাক বিস্ময়ে সৌন্দর্য খোঁজে বুড়ো, যুবক, যুবতী, বালক।
কবি, লেখক ও সাংবাদিক ইকবাল কবীর রনজু তাঁর বক কবিতায় ঠিক এভাবেই বিবৃত করেছেন বকের চাওয়া পাওয়া। আমাদের কবিতা সাহিত্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটা জায়গা দখল করে আছে বিভিন্ন রকমের বক।
বসন্তে প্রকৃতি যখন সাজছে নব রূপে ঠিক এমন সময় চলনবিলের অপার সৌন্দর্য নজর কাড়ছে সকলের। মাঠের পর মাঠ শস্য ক্ষেত। বোরো ধান, খেশারি, মশুর, রসুন, গম, কালোজিরা, ভুট্টাসহ নানা ফসলে মাঠ ভরা। কৃষকের চোখে মুখে এসময় হাসির ঝিলিকের পাশাপাশি ফসল সুষ্ঠুভাবে ঘরে তোলা নিয়ে কিছুটা শঙ্কাও বিরাজ করে। প্রকৃতি যেন নিজে হাতে সাজিয়েছে বাংলাদেশের বৃহৎ এ বিলটিকে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এ বিল যেন ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। বিভিন্ন ফসলের আবাদ হলেও এ মৌসুমে বিপুল পরিমাণ জমিতে বোরো আবাদ হয়ে থাকে। মাঘ-ফাল্গুন মাসে কৃষকেরা জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করেছেন। দেখতে দেখতে ধান গাছগুলো সবুজ গালিচায় পরিণত হয়েছে। ধান গাছের এ সবুজ গালিচার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলছে ঝাঁক ঝাঁক সাদা বক। বকগুলো যখন ধান গাছের ভেতর পোকামাকড় খাওয়ায় ব্যস্ত এমন সময় যতই সন্তর্পণে এগুনো যাবে কাছাকাছি পৌছতে না পৌছতেই ধানক্ষেত ছুইয়ে সাদা পাখা ঝাপটে উড়ে দূরে গিয়ে বসবে অথবা উড়তে উড়তে একসময় মিশে যাবে দূর আকাশ নিলীমায়। এ উড়ে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়। এ বিল থেকে ও বিলে অথবা নিজ বাসায় চলে যাওয়া মাত্র।
ফাল্গুন-চৈত্র মাসের সন্ধিক্ষণের চলন বিলের চিত্র এটি। বিলের অধিকাংশ স্থানে পানি না থাকায় এ সময় সাদা বক, কানি বক, নিশি বক বিচরণ করে বোরো ধানের জলাভূমিতে। দীর্ঘ গলা ও পা বিশিষ্ট সাদা বকের পালক প্রাচ্যের পোশাকাদী ও টুপির শোভা বর্ধনে ব্যবহৃত হত। আট প্রজাতির সাদা বকের মধ্যে আমাদের দেশে রয়েছে পাঁচ প্রজাতির সাদা বক। আকারে ৪৫ থেকে ১শ’ ৫০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। পা ও লম্বা ঠোট ছাড়া এদের সারা দেহ সাদা পালকে আবৃত। গাছে বাসা বেঁধে রাতে সেখানে বসবাস করলেও দিনের বেলায় খাদ্যের অন্বেষণে এরা নদী পুকুর খাল বিল জলাশয়ে ছুটে বেড়ায়।
গত শনিবার চাটমোহর-হান্ডিয়াল সড়কের কুঁজোর মোড় থেকে বিন্যাবাড়ি অভিমুখী মেঠো কাঁচা সড়ক ধরে কিছুদূর এগুতেই সবুজ ধান খেতের মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে হেটে চলা সাদা বক নজর কারে। এ গ্রামের রিপন হোসেন বলেন, “প্রতিবছর এ বিলের শোভা বাড়ায় সাদা ধুসর বিভিন্ন রঙের বক। নিষিদ্ধ হলেও সৌখিন শিকারীরা গুলি করে কখনো কখনো বক নিধন করেন; যা কখনোই কাম্য নয়। কেউ কেউ ফাঁদ পেতে আবার কেউ কেউ পোষা বক দিয়ে বুনো বক ধরেন।”
গত রবিবার চাটমোহর-হান্ডিয়াল সড়কের পাশে নিমাইচড়া এলাকার বিলের ধান খেতে প্রচুর পরিমাণে সাদা বকের দেখা মেলে। সহযাত্রী মির্জাপুর ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক ওয়াদুদ হোসেন বলেন, “চলনবিলের চাটমোহর-হান্ডিয়াল সড়কের দুইপাশের ধানক্ষেতে প্রতিদিন শত শত বকের দেখা মেলে। এরা যখন ঝাঁক বেঁধে ধান খেতে হেটে চলে অথবা আকাশে উড়ে বেড়ায় তখন মুগ্ধ হয় মানুষ। এ যেন অবাক করা সৌন্দর্য।”
মনে পড়ে যায়, পুলক বন্দোপাধ্যায় এর লেখা মান্নাদের কন্ঠের সেই চির চেনা গান, ও কেন এত সুন্দরী হলো/অমনি করে ফিরে তাকালো/দেখে তো আমি মুগ্ধ হবোই/আমি তো মানুষ/ও কেন এত সুন্দরী হলো। বকের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে ছবি তুলতে গেলে বকগুলো গানটির মতই ফিরে তাকিয়েছিল। সাদা পালক ঝাপটে বকগুলো একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছিল। মনে হলো পৃথিবীটা যেন একটু খানি বদলে গেছে। পথে চলার সময় হঠাৎ এমন বিনা কাজে বকগুলো যখন সামনে এল তখন দেখে তো আমি মুগ্ধ হবোই।