প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধি করতে নাজমা বেগমের উদ্যোগ

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

এক সময় গ্রাম বাংলার প্রতিটি পরিবার ছিলো একটি কৃষি সমৃদ্ধ বাড়ি। প্রত্যেক বাড়িতে ছিলো নানান ধরনরে উদ্ভিদ বৈচিত্র্য। বাড়িতে চাষ হতো নানান ধরনের সবজি, মসলা। কৃষি জমিতে হতো নানান গুণের নানান জাতের ধান যার বৈশিষ্ট্য ছিলো আলাদা আলাদা। হরেক রকমের ফলজ গাছ। পুকুর,বিল ও খালে ছিলো নানান ধরনের মাছ। প্রাণী সম্পদের মধ্যে ছিলো গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ভেড়া, মহিস, কবুতর, বিভিন্ন ধরনের পাখি। বাড়িগুলো এমন সবুজে মোড়ানো ছিলো যে বাইরে থেকে বাড়ির ভেতরকার কিছু দেখা যেতো না। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেগুলো এখন যেন শুধু স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। ১৯৬০ দশকের পর থেকে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ এবং বাণিজ্যিক হারে কৃষি ফসল উৎপাদনের জন্য সবকিছু বিলিন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু গ্রাম বাংলা অসংখ্য নারী এখন নির্জনে নিভৃতে নিজস্ব জ্ঞান অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তেমনই একজন নারী হলেন শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের শংকরকাটি গ্রামের কৃষাণী নাজমা বেগম।

নাজমা বেগমের মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৫ বিঘা। যার মধ্যে ২ বিঘার মতো ভিটাবাড়ি ও পুকুর। সেখানে বারোমাস বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ করেন। প্রতি মৌসুমের জন্য আলাদা আলাদা ফসল চাষ করেন তিনি। বর্তমানে তাঁর বাড়িতে ফলজ ও কাঠ জাতীয় উদ্ভিদ নারকেল, পেয়ারা, খেজুর, তাল, কদবেল, আম, জাম, লেবু, আমড়া, সবেদা, পেপে, কলা, ডালিম, নইল, আমড়া রয়েছে। এছাড়া কাঠ জাতীয় আকাশমনি, নিম, শিশু, গাব, মেহগনি ও বাঁশ গাছ আছে। সবজির মধ্যে রয়েছে ডাটাশাক, ঢেড়স, পুঁইশাক, লাই, মিষ্টিকুমড়া, তরুল, ঝিঙা, বরবটি, শিম, উচ্ছে, কুশি, শসা, লালশাক, পালনশাক, কচু, আলু, চুবড়ি আলু, বেগুন, মুলা, ওলকপি, কচুরমুখী, মানকচু, জলপানকচু, সোলাকচু, আদা, হলুদ, ঝাল ইত্যাদি। পরবর্তী বছরে চাষাবাদের জন্য তিনি বীজ সংরক্ষণ রাখেন। পাশাপাশি অচাষকৃত উদ্ভিদ হিসাব আছে কলমি, সাদা গাদো, লালগাদো, তুলসি, পেপুর, ক্ষুদকুড়ি,আমরুল, হেন্না, বউটুনি, সেঞ্চি, কাটানুটে, তেলাকচু, থালারুটিম ঘোড়াসেঞ্চী, ঘুমশাক, ঘেটকুল, নোনা গাদা, গিমে শাক, কাথাশাক, হেলাঞ্চ, বাকসা, নিমুখা, কালোবিসায়, মিছরিদানা, ডায়বেটিস, উল, তিতবেগুন, ঝাউগাছ, পাথরকুচি ইত্যাদি সংরক্ষণে রেখেছেন। পুকুর আছে রুই, কাতলাম শোল, পুটি, কাকড়া, চিংড়ি, মনোসেক্স, তেলাপিয়া, ভেটকে, পার্শ্বে, মাগুর, কাইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ।

এগুলোর পাশাপাশি পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য রাজ হাঁস ৭টি, মেরি হাঁস ১০টি, ছাগল ৩টি, কবুতর ৫টি, মুরগি ৩৫টি পালন করেন। সাথে নিজের ইনকিউবেটর মেশিন এবং হাঁস মুরগির তা দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রির কাজ চলমান রেখেছেন। বছরে হাঁস মুরগির ডিম উৎপাদন করে খরচ বাদে প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো আয় করেন। সাথে নিজ গ্রাম এবং পাশ্ববর্তী গ্রামের জনগোষ্টীর চাহিদা অনুযায়ী স্থানীয় গলা ছেলা মুরগি ও হাঁস সরবারাহ করতে পারছেন।

নাজমা বেগম জানান, তিনি এ কাজগুলো আগে করতেন তবে অল্প পরিসরে। তবে যেদিন থেকে বারসিক এর সহায়তায় বিভিন্ন গ্রামে অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরে যান সেদিন থেকে তাঁর উদ্যোগগুলো বৃহৎ পরিসরে বৃদ্ধি করতে শুরু করলেন। তিনি বলেন, আমার বাড়িটা একটা কৃষি বাড়ির রূপ দিয়েছি। এখানে বিভিন্ন ধরনরে ফসল চাষ, হাঁস, মুরগি পালন, অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, জৈব বালাইনাশক সব কিছু থাকাতে গ্রামের অনেক মানুষ এগুলো দেখে আগ্রহী ও উদ্যোগী হয়েছে। অনেক পরিবার আমার মতো করে চর্চা শুরু করেছে। আমার উৎপাদিত এ সবজি, হাঁস-মুরগি, ও তার ডিম বিক্রির জন্য কোন সময় বাজারে যেতে হয় না। আমার বাড়িতে থেকে খুচরা ও পাইকারীভাবে গ্রামের লোকজন এবং ফেরিওয়ালারা এসে নিয়ে যায়্। সবার কাছে এখন আমি নাজমা আপার কৃষি বাড়ি নামে পরিচিত হয়েছি।

তিনি আরো বলেন, বিগত সময়ে বারসিক থেকে আমার বাড়ি উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উপকরণ সহায়তা পেয়েছি। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার যোগাযোগ তৈরিও হয়েছে। আমার ২০ জন সদস্যের একটি নারী সংগঠনও আছে। সেখানে আমরা ১০০ টাকা করে সঞ্চয় জমা করছি। করোনার এ সময়ে আমি আমার বাড়ি থেকে নিজ ও পাশ্ববর্তী গ্রামের প্রায় ৬০ জনকে সবজি বীজ, ৫০ জনকে বিভিন্ন সবজি দিয়ে সহায়তা করেছি। এছাড়া অনেকে আমার বাড়ি থেকে চারা নিয়ে গেছেন। আমার বাড়িটিতে আরো বিভিন্ন ধরনের সম্পদে ভরপুর করবো এটাই আমার আশা। সাথে পুষ্টি ব্যাংক বা শত বাড়ির জন্য বারসিক ধারাবাহিকভাবে আমাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে।

উপকূলীয় এলাকা ভৌগলিক কারণে লবণক্ততা হিসাবে পরিচিত। এলাকার পরিবেশ লবণাক্ততা। এ লবণাক্ততার কারণে দিনে দিনে অনেক প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে। তারপরও অনেক নারী এখনো আমাদের প্রাণবৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করতে নানান ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছেন। নাজমা তাদের মধ্যে একজন।

happy wheels 2

Comments