সাম্প্রতিক পোস্ট

৪২ বছর যাবত পুঁথি পাঠ করে চলেছেন ঘিওরের আওয়াল

মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক ॥  

আরে এই…. “দয়াল গাজী উঠলে না’য়, বনের বাঘে বৈঠা বায়। পানির কুমিরে টানে গোঙ্গ…। বনের যত হিংস্র প্রাণী, ধোঁয়ায় গাজীর চরণখানি। পশু পাখি সালামও জানায় ”. . . আরে এই…. এমনই মনকাড়া ছন্দ আর দরাজ কন্ঠে ৪২ বছর ধরে পুঁথি পাঠ করে লোকজনকে সুরের মায়ায় মোহনীয় করে রেখেছেন ঘিওরের আব্দুল আওয়াল।
manikgonj 1
এক সময় গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক ছিল পুঁথি পাঠ। কিন্তু কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার সেই ঐহিত্য। তবে বিলুপ্ত প্রায় সেই পুঁথি পাঠ করে এখনো গ্রামের সাধারণ মানুষদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষা, ইতিহাস, রাজা বাদশাদের কিচ্ছা, ও বিভিন্ন সচেতনতামূলক জ্ঞান দান করে যাচ্ছেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার প্রত্যন্ত পয়লা গ্রামের আব্দুল আওয়াল মিয়া। জেলার ঘিওর উপজেলার পয়লা গ্রামের মৃত আব্দুর রহিমের ছেলে আব্দুল আওয়ালের বয়স এখন ৬২। জীবনের ৪২টি বছর ধরে  তিনি গ্রামে গ্রামে সাধারন মানুষদের মাঝে পুঁথি পাঠ করে আসছেন। পারিবারিক জীবনে আওয়ালের ২ স্ত্রী, ৫ ছেলে ও ৬ কন্যা সন্তান রয়েছে।

বাবার রেখে যাওয়া বিঘাখানেক জমিতে চাষাবাদ করে কোনরকমে চলে তাঁর সংসার। আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাতের পর রাত তিনি কাটিয়েছেন পূঁথি পাঠ করে। শখের বসে পুঁথিপাঠ করে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটানো আব্দুল আওয়াল জানান, বাল্য শিক্ষার গন্ডি তিনি ছাড়াতে পারেননি। তবে বাল্য শিক্ষা দিয়েই তিনি পড়ে ফেলতে পারেন অনেক কঠিন ভাষার বই। তিনি আরও জানান, ২০ বছর বয়সে প্রতিবেশী চাচা আব্দুল গনির কাছ থেকেই তাঁর পুঁথি পাঠের হাতেখড়ি হয়। চাচার পুঁথিপাঠ শুনেই তিনি এটিতে আসক্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন সময়ে বাবা মার চক্ষু ফাঁকি দিয়ে তিনি চাচার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন মানিকগঞ্জ ও এর আশে পাশের কয়েকটি উপজেলা। ওই চাচার মৃত্যুর পর থেকে তিনি একাই পুঁথিপাঠ করে বেড়ান।
manikgonj 2.1
তিনি জানান, আগে গ্রামে কোন নবজাতক শিশু জন্মালে ওই শিশুর ৬ দিন বয়সে একটি উৎসব হতো। সেই উৎসবে ডাক পড়ত তাঁর। নবজাতককে সামনে রেখে পুঁথিপাঠ করলে ওই শিশু বড় হয়ে ভালো চরিত্র ও শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত হবে এমনটাই ধারণা ছিল গ্রামে বসবাস করা তখনকার মানুষগুলোর। এছাড়াও গ্রামের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে তিনি কালু গাজী, ছয়ফুল মল্লুক বদিউজ্জামান, সোনাবানু, জঙ্গে কারবালা, লাইলী মনজু, আওলিয়া নিজাম উদ্দিনসহ প্রায় শত খানেক পুঁথি তিনি পাঠ করে থাকেন। সপ্তাহের দুই তিনদিন তার নিজ বাড়িতে বসে পুঁথি পাঠের আসর। পুঁথি শুনতে বিভিন্ন এলাকার অনেক মানুষ এখনো জড়ো হয় তার বাড়িতে। তবে এই পুঁথি পাঠ শুনে নির্দিষ্ট পরিমাণে কোন অর্থ আয়ের চুক্তি না থাকলেও অনেকে খুশি হয়ে নতুন লুঙ্গি, গেঞ্জি ও নগদ টাকা দিতো বলেও জানান তিনি।

এ ব্যাপারে পয়লা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ মাষ্টার জানান, বর্তমানে পুঁথি পাঠের ঐতিহ্য এখন হারাতে বসেছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এর চাহিদা খুবই কম। তবে আব্দুল আওয়ালের পুঁথি পাঠ আমাদের এলাকার গর্ব। পুঁথি পাঠ ঐহিত্য বিলুপ্তির জন্য আব্দুল আওয়াল অনেকটা আক্ষেপের সুরে দায়ী করছেন আকাশ সংস্কৃতিকে। গ্রাম বাংলার এই হারানো ঐহিত্যকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন।

happy wheels 2

Comments