হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী মোরগ লড়াই!
সাতক্ষীরা থেকে মো. আসাদুজ্জামান:
আবহমান বাংলার ঘৌড় দৌড়, লাঠি খেলা, মোরগ লড়াইসহ জনপ্রিয় সব খেলাগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যে ঐহিত্যবাহী মোরগ লড়াই গ্রাম-বাংলার মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ক্রিকেট-ফুটবলের ক্রেজে এই খেলাগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। এসব খেলাগুলো বৈশাখী মেলাসহ বিশেষ বিশেষ দিবসগুলোতে মাঝে মধ্যে দেখা যায়। তখনও কিন্তু এর আবেদন বিন্দুমাত্র কমে নি। সব বয়সের অসংখ্য দর্শক এখনো প্রাণভরে উপভোগ করে এই খেলাগুলো।
এবার পহেলা বৈশাখে সাতক্ষীরা শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে অনুষ্ঠিত তিনদিন ব্যাপী বৈশাখী মেলায় জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ও সাতক্ষীরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। এটি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছিল মেলার অধিকাংশ দর্শকের। বাংলা নববর্ষের দিনটি বাঙালি জাতির জন্য সবচেয়ে আনন্দময় দিনে মোরগ লাড়াই এই উৎসব আরো রঙিন করে তুলেছিল। সত্যি মোরগ লড়াইয়ের মাধ্যমে বৈশাখী মেলায় আসা প্রবীণরা যেন খুঁজে পেয়েছিল হারোনো স্মৃতি ও নতুন প্রজন্ম জানতে পেরেছিল ঐতিহ্যবাহী খেলার ইতিকথা।
মোরগ লড়াই আমাদের দেশের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ পরিচয়। গ্রামবাংলার জনপ্রিয় ক্রীড়ানির্ভর চিত্তবিনোদনের মাধ্যম ছিল মোরগ লড়াই। সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল এলাকার অধিবাসী প্রবীণ আকরম আলী বলেন, “আমাদের সময়ে ক্রিকেট, ফুটবল ছিলো না; মোরগ লড়াই ছিলো। ছোট বেলায় কোথাও মোরগ লড়াই আয়োজন হলে তা দেখতে সব বয়সের মানুষ তো বটেই, এমনকি দূর-দূরান্ত থেকেও হাজারো মানুষ ছুটে আসতো। এ খেলাকে কেন্দ্র করেই সেখানে তৈরি হতো এক উৎসমুখর পরিবেশ।” গ্রামবাংলার অন্যান্য ঐতিহ্যের মতো অল্প কতক বৈশ্বিক খেলার ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে জনপ্রিয় মোরগ লড়াইও। বিশেষ করে মানুষের বিনোদনে প্রযুক্তির প্রভাব মোরগ
লড়াইয়ের আবেদন ফুরিয়ে গেছে। সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর এলাকার দশ বছরের শিশু রাইসুল ইসলাম বলেন, “মোরগ লড়াইদের বিষয়ে বইতে পড়েছি এবং বড়দের কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি। এই বার বাবার সাথে বৈশাখী মেলায় গিয়ে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মোরগ লড়াই দেখেছিলাম। এর আগে কখন মোরগ লড়াই দেখিনি। এটি দেখে খুব ভালো লাগছে। এটি নিয়মিত করা হয় সেই দাবি করছি।”
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি পরিবারে মোরগ লড়াইয়ের জন্য বিশেষ প্রঝাতির মোরগ লালন পালন করেন। যে কোন মোরগ দিয়ে এই খেলা হয় না। পাশাপাশি লড়াইয়ের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মোরগগুলোকে উপযুক্তভাবে তৈরি করতে হয়। মেলায় আগত এমন একটি মোরগ এর মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, “মোরগ লড়াই সুন্দরবন এলাকার ঐতিহ্যবাহী খেলা। আমার বাপ-দাদার আমল থেকে এই মোরগ পালন করে আসছে। তারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মোরগ লড়াই দেখাতেন। এটি টিকিয়ে রাখতে আমরা কয়েকটি পরিবার এখনও এই বিশেষ মোরগ পালন করি এবং মোরগদের লড়াইয়ের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।” সুন্দরবন এলাকায় এটি কি পরিমাণ জনপ্রিয় সেটি বোঝা যায় একটি মাঠের নামকরণ থেকে। সুন্দরবনের নিকটে ভেটখালি উপজেলায় একটি মাঠ আছে- যেটি পরিচিত ‘ভেটখালি মোরগ লড়াই’ এর মাঠ বলে পরিচিত। প্রতি মাসে ৩-৪ বার এই মাঠে মোরগ লাড়াই হয়ে থাকে। এখানে এই অঞ্চলে অনেকে তাদের মোরগ নিয়ে আসে। এখানে প্রায় ২শতাধিক মোরগ হাজির করে খেলা দেখানো হয়। আরো জানা যায়, উকুলীয় একালায় আদিবাসি মুন্ডারা প্রধানত এই দেশীয় খেলাটিকে এখনো ধরে রেখেছে। তাদের প্রতিটি বাড়িতে মোরগ পালন করা হয় এবং লাড়াইয়ের জন্য প্রশিক্ষণও দেয়া হয়ে থাকে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে তাদের ঐতিহ্যবাহী ষাড় এর লড়াই আধুনকায়ন এর ফলে এখনো বেশ জনপ্রিয়। তারা তাদের দেশীয় খেলাগুলোকেও ধরে রেখেছে বৈশ্বিক খেলাগুলোর পাশাপাশি। আর এটি সম্ভব হয়েছে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার ফলে। তাই আমাদের দেশেও সরকারের পাশাপাশি মিডিয়া এবং বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে দেশীয় খেলাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য। মেলায় আগত হাজারো দর্শনার্থীদের প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট্যদের কাছে দাবী শুধু বিশেষ বিশেষ দিবসগুলোতে না; নিয়মিত আয়োজন করা হোক গ্রাম-বাংলার এতিহ্যবাহী লাঠিখেলা, মোরগ লাড়াই, ঘৌড় দৌঁড় সহ প্রভৃতি।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ লেখক