স্থানীয় উদ্যোগে ২৯টি গ্রামের ১৩০৬ টি পরিবারের মাঝে সবজীবীজ বিনিময়

শ্যামনগর সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
কৃষির মূল ভিত্তি হলো বীজ। আমাদের দেশের নারীরাই বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের জাত উদ্ভাবন, জাত ও বীজ সংরক্ষণে এক অগ্রনী ভূমিকা পালন করে আসছেন। এ দেশের কৃষক প্রতিটি ফসল থেকে বীজ সংরক্ষণ ও পারষ্পারিক আদান প্রদানের মাধ্যমে প্রত্যেকে গড়ে তুলেছিল নিজস্ব বীজ ভান্ডার। মোট কথা, বীজের উপর নির্ভরশীল কৃষকের জীবন, জ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতি। কৃষকেরা মৌসুম ও জমির ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানীয় প্রজাতির নানান জাতের ডাল, পাট, সরিষা, তিল, গম, ধান, মসলা ও সবজী চাষাবাদে পারষ্পরিক ফসলের বীজ বিনিময় করতো। কিন্তু ১৯৮০ এর দশকে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, কৃষি জমির অকৃষি খাতে ব্যবহার, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ ও আধুনিক কৃষির নামে বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যিক আগ্রাসন এ অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকের নিয়ন্ত্রনের উপর আঘাত হানে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহি ফসল বৈচিত্র্য সংরক্ষণে গ্রামীন জনগোষ্টীর জ্ঞান ঘুন ধরে চলেছে সবুজ বিপ্লবের নামে তথাকথিত বাণিজ্যিক কৃষি, আধুনিক কৃষি নামে ধোকা এবং এদেশের বৈচিত্র্যময় ফসল বীজ আদানপ্রদানের মাধ্যমে কৃষক -কৃষক যে সামাজিক ও আত্মীয় বন্ধন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, সে বন্ধনেও ফাটল ধরেছে। কৃষি ও কৃষককে বানিজ্যিক পুজি করে গড়ে তোলে বহুজাতিক কৃষি ব্যবসায়।

বীজ বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হোক সম্প্রীতির বন্ধন

বীজ বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হোক সম্প্রীতির বন্ধন

তারপরেও গ্রাম বাংলার কৃষক নিরব আন্দোলন ও সংগ্রাম ক রে এদেশের কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রা নিশ্চিত করার জন্য নানান উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে স্থানীয় কৃষক-কৃষানী ও জনসংগঠনগুলো। একইভাবে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার স্থানীয় কৃষক-কৃষানী ও জনসংগঠনগুলো বিভিন্ন মৌসুমে নিজ গ্রামে, নিজ সংগঠনে ও অন্য গ্রামে স্থানীয় বৈচিত্র্যময় বীজের উপর স্থানীয়দের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। প্রান্তিক দরিদ্র পরিবারগুলোর বীজ সহায়তা, পরিবার এবং সম্প্রদায় এর মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরিসহ এলাকা উপযোগি ফসল বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, চাষাবাদ, বীজের জন্য বাজারনির্ভরশীলতা কমানো, পুষ্টি চাহিদা পুরণ, পারিবারিক আয় বৃদ্ধি, বীজ উৎপাদন, বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে স্থানীয় জাতের বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ধারাবাহিক ভাবে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে। তার মধ্যে বীজ বিনিময় অন্যতম।
২০১৭ সালের বর্ষামৌসুে কর্মএলাকার কৃষক সংগঠন সংগঠনগুলো ও সম্পদ ব্যক্তিদের নিজ নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন গ্রামের কৃষক-কৃষানীর নিকট থেকে সবজীবীজ সংগ্রহ করে অন্য গ্রাম তথা দরিদ্র পরিবারের মধ্যে বিনিময় করে চলেছে। ২০১৭ সালে বর্ষা মৌসুমে স্থানীয় কৃষক-কৃষানী, জনসংগঠনের উদ্যোগে শ্যামনগর এলাকার ১১ টি (দাদপুর, চন্ডিপুর, যাওয়াখালী, আড়পাঙ্গাশিয়া, কালমেঘা, সোয়ালিয়া, ধুমঘাট, বেতাঙ্গী, চকবারা, বাদঘাটা, ধুমঘাট) গ্রামের ২৭টি পরিবারের নিকট থেকে ১২ প্রকার বর্ষাকালীন সবজীবীজ সর্বমোট প্রায় ৮ কেজি সংগ্রহ করে শ্যামনগর উপজেলার ২৯ টি গ্রামের (সোনামুগারী, হায়বাতপুর, ভুরুলিয়া, জাওয়াখালী, বেতাঙ্গী, খুটিকাটা, জয়নগর, নকিপুর, বাদঘাটা, আটুলিয়া, দাদপুর, খেগড়াদানা, চন্ডিপুর, বড়কুপোট, চকবারা, পদ্মপুকুর, কল্যাণপুর, আড়পাঙ্গাশিয়া, দাতিনাখালী, গোপালপুর, কালমেঘা, পানখালী, সোরা, মানিকখালী, কালিনগর, কেদারবাজার, বন্যতলা, গড়কুমারপুর, হেঞ্চী) ১৩০৬ টি পরিবারের মাঝে বিনিময় করে।
বীজ বিনিময় প্রসঙ্গে বীজ গ্রহণকারী কৃষক-কৃষানীরা জানান, বিভিন্ন গ্রাম থেকে আমরা যে ১৩০৬ টি পরিবার বীজ গ্রহণ করেছি। আগামী বর্ষা মৌসুমে এ বীজ থেকে আমরা সবজী উৎপাদন করে ও নিজেরা বীজ সংরক্ষণ করে কমপক্ষে আরো ২০০০ পরিবারের মাঝে বীজ সহযোগিতা করতে পারবো। বীজ গ্রহণকারী বেতাঙ্গী গ্রামের কৃষানী অনিতা রানী বলেন, “এভাবে যদি আমরা প্রত্যেক গ্রামের যারা বীজ গ্রহণ করেছি তারা বীজ সংরক্ষণ করে প্রতি মৌসুমে কিছু মানুষকে বীজের সহযোগিতা করতে পারি তাহলে আমাদের আর বাজার থেকে বীজ কিনতে হবে না এবং বাজারের বীজের উপর নির্ভরশীল হতে হবে না। এভাবে সবজী ও সবজীর বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে কর্মএলাকার জনগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে পারষ্পারিক সম্পর্ক তৈরি ও উন্নয়ন সহ সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছে।

happy wheels 2

Comments