বীজ আপা সখিনা
নেত্রকোনা থেকে রোখসানা রুমি
সখিনার মতো গ্রামীণ নারীরা আপন মমতায়, যতেœ টিকিয়ে রেখেছেন শস্য ফসলের বৈচিত্র্য, শাকসবজির নানান জাতের বীজের সমাহার। তাঁরাইতো টিকিয়ে রেখেছেন গ্রামীণ জীবনের বীজ বিনিময়ের সংস্কৃতি, সরবারাহ করছেন বিষমুক্ত খাবার, পাশাপাশি সচল রেখেছেন দারিদ্রতার সাতকাহনে ঢাকা জীবনের চাকাকে।
নেত্রকোনা জেলাতে দেখা যায় বৈচিত্র্যময় ফসলের সমাহার। তবে উন্নত কৃষির নামে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামীণ নারীদের আপন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় গড়া স্বনির্ভর, পরিববেশবান্ধব। রাসায়নিক কৃষি ও সবুজ বিপ্লবের নারীদের দীর্ঘদিনের জ্ঞান অভিজ্ঞতাকে করে তুলেছে মূল্যহীন। প্রকৃতিকে কওে তুলেছে বিপন্ন। তবে এত বিপন্নতা আর বিনাশের কালেও এখনও নেত্রকোনা অঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা বৈচিত্র্যময় শস্যফসল চাষ করে, পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করে স্বনির্ভও কৃষিব্যস্থাসহ প্রাণবৈচিত্র্য কে সংরক্ষণের জন্য করে চলেছে নিরন্তর প্রচেষ্টা। এমনি একজন উদ্যোগি নারী সখিনা আক্তার।
নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম ভূগিয়া। ছায়াঘেরা সুনিবিড় শস্য ভরা ভুগিয়া গ্রামটি রামপুর বাজার থেকে এক কিলোমিটার পূর্বে। ভুগিয়া গ্রামের শাপলা শালুক কৃষাণী সংগঠনের সভাপ্রধান সখিনা আক্তার। সখিনা আক্তারের বয়স (৩৬+)। তিনি দুই সন্তানের মা। সংসারের অভাব তার পিছু ছাড়েনি কোনদিন। সন্তানের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দেবে এ সামর্থ তার ছিল না। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা করার চিন্তা করতে পারেনি। স্বামীর বাড়ীভিটাসহ মোট ৫০শতাংশ জমি আছে। সখিনা আক্তারের স্বামী খেটে খাওয়া একজন দরিদ্র কৃষক।
সখিনা আক্তার ছোটবেলায় তার মায়ের কাছ থেকে বসতবাড়িতে সবজি চাষ, হাসঁ মুরগি পালন, গরু পালন, অল্প জমি থেকেই কিভাবে ফসল চাষ করে সংসার চালানো যায় সে বিষয়ে ধারণা অর্জন করেন। সখিনা আক্তার সংগঠনের সকল সদস্যদের মাঝে সবজি বীজ ও মাসকলাই ডাল বিতরণ করেন এবং পাশে ৩টি গ্রাম রামপুর, নগুয়া, ভগবতীপুর গ্রামে ৪ জন নারী ও আটপাড়া উপজেলা তেলিগাতি ইউনিয়ন শ্রীপুর গ্রামে একজন নারী মাঝে সবজি বীজ বিনিময় করেন। তিনি এসব নারীদেও সাথে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, মাসকালাই, লালশাক, মূলা, ডাটা, মরিচ, ৫ জাতের সীম পালন শাক, মিষ্টিকুমড়া বীজ বিতরণ করেন। বীজ বিনিময়ের পাশাপাশি তিনি এসব নারীদের সবজি ও ডালের বীজ সংরক্ষণ করার আহ্বান জানান।
সখিনা আক্তারের ৫০টি হাসঁ, ১০টি মুরগি, ৩টি ছাগল ও ৩টি গরু রয়েছে। সেগুলোর মল দিয়ে তিনি জৈব সার তৈরি করেন। তিনি জৈব বালাইনাশক, জৈব সার তৈরি ও বীজ সংরক্ষণে পারদর্শী হওয়ায় তার বাড়ির আশেপাশে নারীদের সহ তাঁর আত্মীয়দের মাঝে তিনি এই জ্ঞান সহভাগিতা করতে পারছেন। তাই তো সখিনা আক্তারের কাজ দেখে আরও ৩০ জন নারী এ কাজের সাথে যুক্ত হয়। তাঁরা অঙ্গীকার করেন বিষমুক্ত সবজি চাষ করবেন। সখিনা আক্তার বলেন, “আমি সবজি ,বীজ, মোরগ, দুধ বিক্রি করে কিছু টাকা জমাতে পারি। আমি যে সবজি চাষ করি তাতে বিষ থাকে না। আমার পরিবারসহ আরও তিনটি পরিবার বাজার থেকে কিছু কিনে খেতে হয়না। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করি।”
তিনি আরও বলেন, “আমার ফসলের আলাদা মূল্যই আছে বাজারে। আমার বাড়ি থেকে লোকজন এসে সবজি নিয়ে যায়। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যে, আমি সকল ফসলের বীজ নিজেই সংরক্ষণ করে রাখব। অন্যদেরকে বীজ দিয়ে সহায়তা করবো। জৈব পদ্ধতিতে চাষ করতে অন্যদেরকে সহযোগিতা করব।” সখিনার মতো গ্রামের নারীরা তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বদলে দিতে তাদের জীবনের চাকা।