কষ্ট করে সফল সাফিয়া বেগম

মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল

‘নানী যাইগা’ বলে দুটি কিশোর বয়েসি ছেলে মোটরসাইকেলে চেপে চলে গেল। আমরা বাড়ি প্রবেশ করলাম। মানিকগঞ্জের বায়রা গ্রামের সাফিয়া বেগমের (৫৬) বাড়ি। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল আমাদের সাদরে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন সাফিয়া বেগম। বাঁশের চটের বেড়া, একটা টিনের ঘর, বাড়ির উঠুনে সদ্য প্রসূত বাছুর ও গাভী। গাভীটি বাছুরের শরীর চাটছে ক্রমাগত। আমাদের বসতে দেওয়া হলো বাড়ির উঠোনে। সাফিয়া বেগম তখনও দুপুরের খাবার খাননি। আমরা বললাম পরে আসবো, বলতেই তিনি রাস্তা আগলে দাঁড়ালেন, বললেন, “আসছেন যখন না কথা বলে, না খেয়ে যাওয়া যাবে না।”
জীর্ণ শরীরের একজন মধ্য বয়স্ক মানুষ। কিন্তু কি তেজদ্বীপ্ত। বললেন “মুক্তিযুদ্ধের একবছর পর আমার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল ১০-১১ বছর। বিয়ের পরও শিশুদের সাথে হেসে খেলে দিন কেটেছে কিছুদিন।”

dsc05110
তিনি খুব দুঃখভরা গলা বলছিলেন, “ভাই আমার জীবনে সুখ শান্তি কোনদিনই ছিল না। ৬ সন্তান নিয়ে স্বামীর সংসার করেছি। স্বামী আমারে সারাটা জীবন জ্বালাতন করেছে। মনের দুঃখে এক মেয়েরে অন্যের কাছে পালক দিছি। ধারা বুনে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। কতই না কষ্ট করছি তার বর্ণনা দিতে পারবো না।”
তিনি আরো বলেন, “বারবার কন্যা সন্তান জন্ম দেবার কারণে স্বামী, শ্বাশুরীর নির্যাতনে আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গেছে। একদিকে স্বামী জ্বালাতন করতেন, মারধর করতেন অন্যদিকে দেবর, ভাসুররাও দেখতেন না। দ্বিতীয় কন্যা সন্তান জন্মানোর পর আমারে কেউ দেখভাল করে নাই। আমারে ঘরে আটকাইয়া রাখছে, খাওন দেয় নাই। কিন্তু আমি সাহস হারাইনাই। আমি নিজে কষ্ট করে সন্তানদের মানুষ করেছি।”

তিনি উঠুনে বেঁধে রাখা গরুটি দেখিয়ে জানালেন, “এই গরু থেকে তিনটি বাছুর বিক্রি করেছি, ৬০ হাজার টাকার দুধ বিক্রি করাসহ প্রায় তিন লাখ টাকা কামাইছি। আমার এক ছেলেকে মানুষের কাছে চেয়ে চিন্তে বিদেশ পাঠাইছি। ছেলে আমার ভালো আছে। আমি মানুষের বেবাক ধার দেনা শোধ করে দিছি।” তিনি বলেন, “আমার শরীকরা আমার সাথে ভালো আচরণ করেন না। তারা বলেন আমার স্বামীর সম্পদে আমার হক নাই। আমি গ্রামের মাতব্বরদের নিয়ে সংগ্রাম কইরা যাইতাছি। সুযোগ পাইলেই শরীকরা আমার ভিটা মাটিটাও দখল করে নিতে চায়।”

তিনি জানান, তার সামান্য একটু জমি আছে। সেই জমিতে শাক-সবজি ফলাই,সরিষা, আলু বুনেন, কখনো ধান করে এই দিয়েই জীবন চলে। তিনি মেয়েদের পড়াশুনা করানোর জোর চেষ্টা করেছেন। এক মেয়ে মেট্রিক পাশ করেছে অন্য দুইটা ৮ম ও সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে তাদের বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে ৮ম শ্রেণী পাশ। তিনি বলেন, “মেয়েরা বিয়ের পর আল্লাহর রহমতে সবাই সুখে আছে। আমার যে সন্তানকে পালক দিয়েছিলাম সেও সুখে আছে। স্বামী নিয়ে আমারে দেখতে আসে-থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “আমার এই উন্নয়ন আর ঘুইরা দাঁড়ানোর জন্য সবচেয়ে ভূমিকা সংগঠনের। আমি বারসিক’র সহযোগিতায় কৃষক-কৃষাণীদের নিয়ে মিটিং করি, কিভাবে জৈব সার তৈরি করে তা শিখাই, তাদেরকে ভালো কিছু করার সাহস যোগাই। এভাবেই আমি নিজেকে তৈরি করেছি আর অন্যদেরও তৈরি হতে সাহায্য করে চলেছি। সবাইরে এইটা বুঝাই সবই সম্ভব সাহস আর মনের জোর থাকলে।”

dsc05107
হঠাৎ সাফিয়া বেগম একটা বড় পাতিল নিয়ে আসলেন আর তার থেকে তুলে ধরলেন বিশাল আকৃতির শোল মাছ। বললেন, “হুন্ডাওলা যে নাতিরে দেখলেন সেই মেয়ের ঘরের নাতি দিয়া গেল। এইটা ফুরাইলে আরেক মেয়ে পাঠাবো। আমার এখন আর কোন অভাব নাই। কিন্তু আমার স্বামী গত ৪ বছর আগে অসুখে ভুইগা মইরা গেছে। আমার ছেলে এখন বিদেশ থেকে বলে মা তোমার কি লাগবো, আমি কইতে পারিনা বলে তার চোখ ভিজে ওঠে।”

একজন সাফিয়া বেগম আমাদের গ্রাম বাংলার হাজারো নারীরই প্রতিমূর্তি। কিন্তু তার মতো এত সংগ্রাম করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবার গল্প কয় জনের আছে? আমরা তার বাড়ি থেকে যখন বিদায় নেব চোখ পড়ে তার পেঁপে গাছটির দিকে। গাছে তিনটি পেঁপে পেকে আছে। তিনি আমাদের সেই পেঁপে না খাইয়ে ছাড়বেন না। কথা দিয়ে আসতে হলো পরের বার এসে খাব। গরুটি তখন হাম্মা ডাকছে , আসিয়া বেগমও তাকে খাবার দেবার জন্য ছুটে যাচ্ছেন।

happy wheels 2