মরুময় বালি ও পাথুরে মাটিতে সবিতা মানখিনের টিকে থাকার সংগ্রাম

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা

নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের পাতলাবন একটি ভারতীয় সীমান্ত অধ্যূষিত গ্রাম। এই গ্রামেই এক সময় প্রচন্ড ভূমিকম্পে বড় একটি পাহাড় ধসের ফলে মহাঢেউ নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয় এবং পুরনো নদীটি বালি ও পাথরে ভরাট হয়ে সমতল ভূমিতে পরিণত হয়। বর্তমানে এই বালি ও পাথুরে জমিতে গারো আদিবাসীদের বসতি গড়ে উঠেছে এবং টিকে থাকার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চলছে। DSC07030এই গ্রামে প্রায় ১২০টি পরিবার আছে। তার মধ্যে প্রায় ৯টি পরিবার সম্পূর্ণ বালি ও পাথুরে জমিতে নতুনভাবে বসতি গড়ে তুলেছে।  এদের মধ্যে সবিতা মানখিন নামে একজন কৃষাণী আছেন যিনি বালি জমিতে দেশীয় ফলের গাছ, ঔষধি গাছ, ফুলের বাগান, শাকসবজি চাষ করে বালিতে অভিযোজন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মাত্র দু’বছর হলো সবিতা মানখিন ও তার পরিবারবর্গ এই এলাকায় এসেছেন। দু’সন্তানের জননী সবিতা মানখিনের স্বামী একজন দিনমজুর। পাশাপাশি গাসন্ত চিকিৎসা করে থাকেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে তাঁরা প্রায় ১০ কাঠা পাথুরে ও বালিময় জমির উপর তাঁরা বসতভিটে গড়ে তুলেছেন। এরই মাঝেই খড়, বাঁশ, ছন দিয়ে ছোট কুটির তৈরি করেন তাঁরা। এই বছর থেকে চেষ্টা করছে উঠোনেই যে বালি আর পাথর আছে তা দিয়েই সিমেন্ট বাজার থেকে ক্রয় করে নিজেরাই ব্লক তৈরি করে পাকা ঘর তুলবেন।

সবিতা মানখিনের বসতভিটা শক্তিশালীকরণের কাজটির পাশাপাশি আশপাশে জমিতে গাছ রোপণের চেষ্টা করেন। কারণ বালি জমিতে গাছপালা টিকিয়ে রাখা অনেক কঠিন কাজ। সবিতা মানখিন দেশীয় ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। তার বাড়ির চারপাশে তিনি ১১ জাতের ফলের (আম, জাম, কাঁঠাল, পেঁপে, আমলকি, লেবু, পেয়ারা, লিচু, জামরুল, চালতা, জলপাই) গাছ, ৫ ধরনের বনজ (নিম, মেহগনি, ৩ ধরনের বাঁশ, কয়েক জাতের পাহাড়ি বনজ গাছ, আকাশি) গাছ রোপণ করেছেন। এছাড়াও তোকমা, তুলসী, ২ ধরনের লজ্জ্বাবতীসহ নানান ধরনের ঔষধি গাছ রয়েছে তাঁর বাগানে। সবিতা মানখিনের স্বামী একজন কবিরাজ বিধায় পেশাগত কারণে ঔষধি গাছ সংরক্ষণ করতেই হয় তাদের।
Exif_JPEG_420
এছাড়াও সবিতা মানখিন শিমুল আলু, আখ, মিষ্টি আলুও রোপণ করেন নিজেদের পারিবারিক খাদ্য চাহিদা মিটানোর জন্য। ঘরের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ও ঔষধের জন্য রয়েছে ১০ জাতের (৩ জাতের গাদা, ২ জাতের চন্দ্রমল্লিকা, দোপাটি, কাটারমুকুট, ৩ জাতের পাতাবাহার, গোলাপ, ডায়মন্ড, লতাফুল, বোতাম ফুল, কৃষ্ণচ’ড়া) ফুল। যেখানে ফুল রোপণ করেছেন সেখানে তিনি ভালো মাটি বালির উপর প্রলেপ দিয়ে তার উপর জৈব সার দেন। বর্ষাকালে গাছের জন্য পানির তেমন সমস্যা না হলেও শুকনো মৌসুমে (কার্তিক-চৈত্র্য) গাছের গোড়ায় পানি দেয়ার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। নদী থেকে বালতি বা কলসীতে করে পানি বহন করে তিনি গাছের গোঁড়ায় পানি দিয়ে গাছগুলোকে বাচিয়ে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেন।

Exif_JPEG_420

সবিতা মানখিনের স্বামী কাজের জন্য সারাদিনই বাড়ির বাইরে অবস্থান করেন। এমনকি সিলেটের বিভিন্ন জায়গাই কয়েক মাস যাবৎ অবস্থান করে থাকেন। এই সময় সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ও গাছের পরিচর্যা তাকেই করতে হয়। তাই সংসারের অন্যান্য কাজও তাকেই করতে হয়। সংসারের অন্যান্য কাজের মধ্যে তিনি পানি সংগ্রহ, গবাদি পশুপাখি পালন, শাকসবজি চাষ এবং পরিবারের জন্য মাছের চাহিদা পূরণ অন্যতম।

Exif_JPEG_420

Exif_JPEG_420

সাধারণত সবতিা মানখিন মাহাঢেউ নদী থেকেই তাঁর দৈনন্দিন পানির চাহিদা পূরণ করেন। তবে বর্ষাকালে (বৈশাখ-আশ্বিন) ঘরের সামনেই বালি খুড়ে ছোট পুকুরের মত তৈরি করে সেখানে পানি জমিয়ে রাখেন। এই ছোট পুকুর থেকেই বর্ষাকালে তিনি প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করেন। এটি তিনি করতে পারেন বছরে ৬ মাস। বাকি ৬ মাসের জন্য তাঁকে পানির জন্য সংগ্রাম করতে হয়। এ সময় নদীই তাঁর একমাত্র সম্বল। নদী থেকেই বালি খুঁড়ে খাবার পানি সংগ্রহ করেন। গ্রামের কোন টিউবওয়েল না থাকায় এ সময় নদীই তাঁর একমাত্র ভরসা। অন্যদিকে জীবিকা অর্জনের জন্য সবিতা মানখিন পশুপাখি পালন করেন। তার পালিত গবাদি পশুপাখির মধ্যে রয়েছে শুকর (২টি), ছাগল (২টি) এবং গরু (৮টি)। অন্যদিকে গবাদি পশুপাখি পালনের কারণে তিনি সহজে এগুলোর বিষ্ঠা বা গোবর থেকে জৈব সার তৈরি করে আবাদী জমিতে ব্যবহার করেন।  এছাড়াও এই বালি জমিতেই তিনি বিগত বছর পরীক্ষামূলকভাবে লাউ রোপণ করেছিলেন। প্রথমবার লাউ বাঁচাতে পারেননি। তবে তিনি ক্ষান্ত না হয়ে পরের বছর আবার আবাদ করে সফল হয়েছেন। মূলত দুই হাত বালি মাটি গর্ত করে তাতে মাটি ও জৈব সার দিয়ে ভরাট করে সেখানে এই লাউ রোপণ করেছেন বলে এবার তাঁর কোন লাউ গাছ মরেনি। লাউ ছাড়াও তিনি শিমুল আলু, চাল কুমড়, মিষ্টি কুমড়া, পেচা কুচু, আদা, হলুদ, বারমাসি মরিচ, বারমাসি বেগুন, চুক্কাই গাছ আবাদ করেন। এতে করে তাঁর সবজির চাহিদা তো পূরণই হয় পাশাপাশি বাড়তি সবজি তিনি বাজারে বিক্রি করে আয়ও করতে পারছেন।
এভাবে নানান প্রতিকূলতা, পাথুরে ও বালি মাটিকে চাষবাস উপযোগী করে সবিতা মানখিন প্রমাণ করেন ইচ্ছা ও উদ্যম থাকলে মানুষ তার ভাগ্য উন্নয়নে যেকোন কাজ করার সামর্থ্য রাখে।

happy wheels 2