প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় হাওরাঞ্চলের নারীদের অভিযোজন কৌশল

কলমাকান্দা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা

শীত মৌসুমে হাওরের চতুর্দিকে সবুজ ধানক্ষেত, সবজি ও অন্যান্য ফসলের প্রাচুর্য, সেচ ও অন্যান্য কাজের জন্য পানির আকাল, পথিকের পথচলায় মেঠোপথে ধূলোর বন্যা। শীতকালে হাওরাঞ্চলে প্রকৃতির এই রূপ নতুন উপমা তৈরি করে বর্ষা মৌসুমে। তখন চারদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশি আর আফালের  (ঢেউ) খেলা। আফালের তালে তালে দিন রাত দোলে ছোট বড় নৌকা, ট্রলার, স্পিডবোড ও লঞ্চ। পানকৌড়ির দল জলে ডুবে আর ভাসে। হাওরের মাঝে তখন মাটির দেখা মেলা ভার। শুধু হিজল ও করচ গাছের অর্ধাংশ দেখা যায় দূর থেকে। প্রকৃতির এই প্রতিরূপের সাথে পরিচিত হারঞ্চলের নারীরা। তাই জ্বালানি, ঘর লেপার মাটি, তোলা চূলা, গবাদি পশুর খাদ্য সংরক্ষণ করেন প্রকৃতির বিরূপ আচরণে তাদের জীবনযাপনকে স্বাভাবিক রাখার জন্য। এছাড়াও বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ পূর্বানূমাণ করে প্রয়োজনীয় আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করেন নিজস্ব লোকায়ত পদ্ধতিতে।

Exif_JPEG_420
ঘূর্নিঝড়, শিলাবৃষ্টি, তুফানের সময় টিকে থাকার কৌশল
হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়, ঘুর্নিঝর, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টিতে সরগরম থাকে আষাঢ়ের আকাশ। এই রকম সময়গুলোতেও দিনের বেলা অনেক পরিবারই পুরুষ শুন্য থাকে। তখন পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার দায়িত্বভার পড়ে গৃহকর্ত্রীর উপর। তখন মা, দাদী, নানীদের শিখানো কৌশলগুলো প্রয়োগ করেন গৃহকর্ত্রীরা। কলমাকান্দা সদর ইউনিয়নের রংশিংপুর, বিশারা ও চিনাহালা গ্রামের নারীরা জানান, ঘূর্ণিঝড় হলে তারা টিন ও টিন জাতীয় জিনিস পিটান, খোল, করতাল, জান বাজান যেন ঘূর্ণিঝড় লোকালয়ের দিকে না এসে অন্য দিক দিয়ে চলে যায়। শিলাবৃষ্টি হলে শিল পাথর, সরিষা পোড়া, ঝাড়, লবণ, পিড়ি (কাঠের তৈরি আসবাবপত্র) উঠানে ছুড়ে দেন যেন শিলাবৃষ্টি তার ঘরের সীমানায় না পড়ে এবং ঘড়, বাড়ি, গাছপালার কোন ক্ষতি না করে।

Exif_JPEG_420

মাটির ক্ষয় রোধ করার কৌশল  
কলমাকান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বড় হাওরের মাঝে অবস্থিত রংশিংপুর গ্রামের চারিদিকে বছরের ৬ (জ্যৈষ্ঠ-কার্তিক) মাস যাবৎ পানি থাকে। আফালের প্রচন্ড আঘাতে বসতভিটের মাটি ক্ষয়ে যায় প্রতিবছর। তাই এই অঞ্চলের নারীরা পুরুষের পাশাপাশি বসতভিতে উচু করে এবং উজাউড়ি (দুল কলমী), কচুরিপানা, বাঁশ দিয়ে আবার কেউ কেউ বস্তায় বালি ভরে বসতভিটে রক্ষায় বেড়িবাঁধ দেয়। এতে একেক পরিবারের পনের থেকে বিশ হাজার টাকা খরচ হয়। আবার কেউ কেউ হিজল, করচ,উজাউড়ি, বেত, মুক্তা, ইকর ও বাতা গাছ রোপণ করে মাটির ক্ষয়রোধ করার চেষ্টা করে। বরখাপন ইউনিয়নের মেদী হাওর পাড়ের কাগজিপাড়া গ্রামের কৃষাণী সুস্মিতা দাস বলেন, “বর্ষাকালে আফালের সাথে সাথে ভাটি অঞ্চল থেকে অনেক কচুরিপানা আয়ে (আসে)। আমরা কোন খরচ ছাড়াই উজাউড়ি ও কচুরিপানা দিয়া বসতভিতের মাটি আটকাইয়া রাখি।”

জ্বালানি সমস্যা সমাধানের কৌশল
রান্নার জন্য জ্বালানি সংগ্রহের দায়িত্ব সাধারণত ঘরের নারীদের উপরেই বর্তায়। তাই ঝড়, তুফান ও বন্যার সময় যেন জ্বালানি সংকটে পড়তে না হয় সেজন্য বৈশাখ মাস থেকেই বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি মজুদ করে রাখেন তাঁরা। সব থেকে সহজলভ্য জ্বালানি হিসেবে হাওরাঞ্চলে নারীরা হাতের কাছে সমসময় পান উজাউড়ি (দুল কলমী) গাছ এবং গোবর। তাই উজাউড়ির ডাল টুকরো করে তাতে গোবর প্রলেপ দিয়ে মুইঠা (জ্বালানি) লাকড়ি তৈরি করে শুকিয়ে মজুদ করে রাখেন। যাদের গোবর নেই তারা শুধুমাত্র উজাউড়ি টুকরো করে দু’ভাগ করে রৌদ্রে শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন। অনেকে ধানের কুড়া বা খড়ের সাথে গোবর মিশ্রণ করে গোল গোল চাকতি তৈরি করে রৌদ্রে শুকিয়ে বস্তায় সংরক্ষণ করেন। আবার কেউ কেউ কাঠের গুড়া, বাঁশ ও গাছের পাতা শুকিয়ে বস্তায় ভরে রাখেন।

তোলা চূলা প্রস্তুতকরণ
বিশারা গ্রামের রুমেলা বেগম (৪০) বলেন, “প্রত্যেক বছর বর্ষাকালে বন্যা অইলে আমাগো গ্রামের ঘর, বাড়ি ডুইবা যায়। রান্নাঘর ডুইবা গেলে রান্না করতে অনেক অসুবিধা

Exif_JPEG_420

হয়। না খাইয়া থাকতে হয়। হেই কারণে আমি মাটি দিয়া ছোট কইরা তোলা চূলা বানাইয়া রাখি। যেন বন্যার সময় ঘরে পানি ঢুকলে চৌকি বা টেবিলের উপরে চূলা বসাইয়া রান্না করতে পারি।” তাঁর মতো অনেক নারী আছেন যারা বন্যার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে তোলা চূলা তৈরি করে রাখেন দূর্যোগ মোকাবেলার জন্য। কেউ কেউ তোলা চূলা তৈরি করেন মাটি দিয়ে, কেউবা টিন দিয়ে আবার কেউ কেউ বালতি, পায়লা, পুরনো বোল বা প্লেইট ও বস্তায় মাটি ভরে এই তোলা চূলা প্রস্তুত করে রাখেন।

ঘর লেপার মাটি সংরক্ষণ
বসতভিতে মাটির, ঘরের ভিত মাটির, এমনকি উঠানও মাটির। মাটিতেই জীবন। তারপরও প্রায় ৭ মাস পর্যন্ত ঘর লেপার মাটির সংকটে পড়েন নারীরা। অথচ হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা প্রায় প্রতিদিনই ঠাকুর ঘর লেপেন। এছাড়াও নিয়মিত লেপতে হয় রান্নাঘর ও চূলার পাড়। অন্যান্য বসতঘর মাসে দু’একবার করে লেপলেও চলে। তাই বৈশাখ মাস থেকেই শুরু হয় মাটির চাকতি তৈরি করে রৌদ্রে শুকিয়ে রাখা। আবার কেউ কেউ ঘরের পাশে বা বারান্দায় মাটির ডিবি তৈরি করে মাটি সংরক্ষণ করেন এবং বর্ষাকালে ঘর লেপার মাটির সংকট দূর করেন।

ঔষধি গাছ সংরক্ষণ
বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় মানুষসহ গবাদি পশুর চিকিৎসার জন্য অনেক নারীই ঘরের আশেপাশে ঔষধি গাছ সংরক্ষণ করেন। যেন ডায়রিয়া, আমাশয়, সর্দ্দি কাশিজনিত অসুস্থ হলে প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে উপশম পেতে পারেন। এ সম্পর্কে চিনাহালা  গ্রামের জৈনবা বেগম (৭০) জানান, একবার বন্যার সময় তার নব প্রসূতী মেয়ে ও নবজাতক শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার মতো কোন সুযোগ পাননি। তার নিজের গাসন্ত ঔষধ জানা ছিল বলে নিজেই অনেক কষ্ট করে কাছাকাছি নদীর ধারে গিয়ে ঔষধ সংগ্রহ করেন এবং তার তৈরি করা ঔষধ খেয়েই মা ও শিশু দুজনই সুস্থ হয়ে পড়েন। সেই থেকেই তিনি শিক্ষা নেন প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলার জন্য ঘরের আশে পাশে ঔষধি গাছ সংরক্ষণ করা জরুরি।

Exif_JPEG_420

বিশারা গ্রামের লালবানুর (৩২) বাড়িটি বর্ষাকালে দ্বীপ বাড়ির মতো মনে হয়। বিগত কয়েক বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া আকস্মিক বন্যায় তার ঘর, বাড়িতে পানি ঢুকলে সপরিবারে তারা চৌকির উপর আশ্রয় নেয়। কিন্তু গবাদি পশুগুলোকে পানিতেই রাখতে হয়। পানি কমে যাওয়ার পর গরুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু চিকিৎসার জন্য ভেলায় করে স্রোতের মাঝে প্রাণী সম্পদ অফিসে নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। গাসন্ত ঔষধ জানা ছিল তাঁর। কিন্তু ঔষধি গাছ ছিলো না আশেপাশে। ফলে সেইবার একটি গরু মারা যায় তাদের। এরপর থেকেই বর্ষার শুরুতেই তিনি ঘরের আশে পাশে মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুর জন্যও ঔষধি গাছ রোপণ করে রাখেন।

প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা করার উপরোক্ত কৌশলগুলো ছাড়াও আরো অনেক কৌশল জানা আছে প্রায় ৬ মাস যাবৎ জলের সাথে বসবাস করা হাওরাঞ্চলের নারীদের। তারা নৌকা বেয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠান, প্রবীণদের হাসপাতালে নিয়ে যান, বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করেন এবং গবাদি পশুর জন্য খাদ্য সংরক্ষণ করেন। দূর্যোগ মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতাগুলো মূল্যায়ন করা হলে তারা সম্মানিত বোধ করবেন বলে তারা জানান।

happy wheels 2

Comments