শাহানারা বেগমের সংগ্রামী জীবন
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
শাহানারা বেগম। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিযনের জযনগর গ্রামে তাঁর বসবাস। স্বামী ও দু কন্যা সন্তানসহ মোট ৪ সদস্যের সংসার তাঁর। নিজেদের জমিজমা বলতে কৃষি জমি ও বসতভিটাসহ ২ বিঘা। তার মধ্যে প্রায ১৫ কাঠার মতো বসতভিটা এবং বাকীটা ধান চাষ করেন। তিনি তার এই স্বল্প বসতভিটায বছরব্যাপী নানান ধরনরে ফসল চাষাবাদ করেন।
বসতভিটায় সবজি চাষের পাশাপাশি তিনি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করেন। পুকুরে নানান ধরনের মাছ চাষও করেন। সব কিছু মিলিয়ে তিনি একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ কৃষিবাড়ি তৈরি করার চেষ্টা করছেন। শাহানার বেগম একজন কর্মঠ নারী। সংসারের উন্নতির জন্য দিনভর পরিশ্রম করে থাকেন। বিয়ে হয় খুবই অল্প বয়সে।
যে সময় তার লেখাপড়া করার কথা ছিলো ঠিক সে সময় স্বামীর সংসারে এসে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। স্বামীরাও ৫ ভাই বাপের নিকট থেকে স্বামী ২ বিঘা জমি পান। আর সে জমিতে স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে শ্রম দিযে সংসারের চাকাকে সচল রাখার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস কিছুদিন পরে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। যার জন্য কোন ধরনের ভারী কাজ করতে পারেন না। আর সেখান থেকে শাহানারা বেগমের সংগ্রামী জীবন শুরু হয়। আর কঠিন এ সময়ের মধ্যে থেকে বের হওয়ার জন্য এবং সংসারের অবস্থা কিভাবে পরিবর্তন করা যায় তার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
শাহানারা বেগম বলেন, গ্রামীণ রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়াতে বাইরের কোন কাজে তো আর করতে পারবো না সেক্ষেত্রে বাড়িতে থেকে কিভাবে আয়ের পথ তৈরি করতে পারি সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করি। সেখানে নিজেদের সবজি চাষের ১০ কাঠা ভিটাসহ পাশের চাচা শশুরের ৫ কাঠা ভিটা ভাগে নিয়ে বছরব্যাপী বিভিন্ন ধরনের সবজি ও মসলা চাষাবাদ করি। দেশিয় প্রাণী সম্পদ পালন করি।”
শাহানারা বেগম জানান, এখন তিনি বসতভিটায় সারাবছর সবজি চাষ করতে পারেন। নিজের বাড়িতে উৎপাদিত এবং গ্রাম থেকে ডিম কিনে এনে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রি করছেন। পাশাপাশি ডিম বিক্রি করছেন। এছাড়াও গবাদী পশুর মধ্যে আছে গরু-২টি, ছাগল- ২টি,পাতি হাঁস-৫টি, মেরি হাঁস ৩টি, মুরগি-২৭টি। এছাড়াও পুকুরে আছে হরেক রকমের স্থানীয় মাছ। দেড় বিঘা ধানের জমিতে দুবার করে ধান উৎপাদন করেন। পাশাপাশি ডাল ও সরিষাও চাষ করেন। প্রতিবছর সবজি চাষ, গবাদি পশু পালন, ধান, ডাল ও সরিষা চাষ করে সংসারের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছি। যা দিয়ে সংসারের সমস্ত খরচ ও মেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে পারছি। পরিবারের আয়ের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখায় সমাজ ও সংসারে সম্মান কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করি। বাড়ির আশেপাশের মানুষকে বিভিন্ন সময সবজি, বীজ দিয়ে সহায়তা করতে পারছি। সবচেয় বড় কথা হলো এখন আর কারোর উপর নির্ভর করতে হয় না।
শাহানারা বেগম আরো বলেন, বিগত সময়ে আমাদের এলাকা দিয়ে ঘূর্ণিঝড় আমফান হওয়ায় আমাদের বাড়ির গাছ-গাছালি ও সবজি ক্ষেতের অনেক ক্ষতি হয। এছাড়াও বর্তমান সময়ে যে করোনা মহামারী চলছে এতে আমাদের কৃষিকাজ কিছুটা হলেও বন্ধ হওযার উপক্রম হচ্ছিলো। কিন্তু সেখান থেকে আমরা বের হওয়ার চেষ্টা করছি। আবার পুরো উদ্যোমে কৃষি কাজ শুরু করেছি। আমফান পরবর্তী ও করোনাকালে আমি বারসিক এর নিকট থেকে সবজি চাষের জন্য নেট ও একটি মটর সহায়তা পেয়েছি। এ সহায়তা আমার কাজের গতিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বলে আমি মনে করি।”
উপকূলীয় এলাকায় শাহানারা বেগমের মতো যেসব নারীরা প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে আমাদের কৃষি সংস্কৃতিকে আগলে রেখে জীবিকা নির্বাহে সংগ্রাম চালিযে যাচ্ছে তাদেরকে মূল্যায়নের মাধ্যমে তাদের কাজকে আরো গতিশীল করতে হবে এবং তাঁদের কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের উৎসাহিত করতে হবে।উপকূলীয় এলাকায় ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবং বর্তমান যে মহামারী করোনায় খাদ্য সংকট দেখা দেওযার উপক্রম হচ্ছে সেখান থেকে বের হওযার জন্য গ্রামীণ নারী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তার এক দৃষ্টান্ত হতে পারে শাহানারা বেগম।