পারমাকালচার বা টেকসই কৃষি: নেপাল অভিজ্ঞতা
মো: শহিদুল ইসলাম
ভূমিকা
কৃষি উৎপাদনের সাথে এখন সবচেয়ে যে বিষয়টি জড়িত তা হলো স্থায়িত্বশীল কৃষি ও পরিবশেবান্ধব কৃষি। যে কৃষি কৃষকের অধিকার সুরক্ষা করেনা ও সেই অঞ্চলের পরিবেশ প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যকে বেঁেচ থাকতে সহায়তা করেনা সেই কৃষি কখনো স্থায়িত্বশীল কৃষি হতে পারেনা। স্থায়িত্বশীল কৃষি কৃষকের এতিহ্যগত নিজস্ব সংস্কৃতি, বীজ ও খাদ্য সার্বভৌমত্বকে গুরুত্বের পাশাপাশি স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশকে গুরুত্ব দেয়। এমনই একটি কৃষি পদ্ধতি পারমাকালচার বা টেকসই কৃষি। পারমাকালচার বা টেকসই কৃষির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বিনিময়ের উদ্দেশ্যে আমরা বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ-বারসিক’র সহায়তায় পাঁচ জনের একটি টিম নেপালের পাটলেখেতে অবস্থিত হাসেরা পারমাকালচার লার্নিং সেন্টার ও কৃষি খামার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করি। উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক এগ্রোইকোলজি বা কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা উন্নতিকরণে বাংলাদশের বিভিন্ন কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলে কাজ করছে। বারসিক স্থানীয় কৃষিপ্রতিবেশ, জাতিগোষ্ঠীর চাহিদা, পরিবেশ ও ভৌগোলিক দিকগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা লার্নিং সেন্টার তৈরিতে বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করছে। যা টেকসই কৃষি ব্যবস্থার উন্নতিকরণে কার্যকরভাবে সহায়তা করছে। পারমাকালচার পদ্ধতিও এমন একটি বিষয় যা টেকসই কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে থাকে। হাসেরা কৃষি খামারটি হাসেরা পারমাকালচার লার্নিং সেন্টার হিসেবেও পরিচিত (HASERA permaculture Learning Centre)।
হাসেরা পারমাকালচার লার্নিং সেন্টারটি নেপালের কাঠমন্ডু থেকে আনুমানিক ৪২ কি:মি পূর্বে পাটালক্ষেতে প্রায় ৪২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। পাহাড়ের নীচে থেকে উপর পর্যন্ত একটি দৃশ্যমান পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষি খারমারটি গড়ে উঠেছে। চারিদিকে ছোট বড় পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত এলাকাটি পাহাড়ী কৃষি সংস্কৃতির আদলে এই হাসেরা পারমাকালচার ফার্মটি অবস্থিত। এলাকাটিতে সারাবছর নাতিশীতোষ্ণ পর্বত জলবাযু থাকে। এই খামার থেকে প্রায় ৩০০ কি: মি: দুরেই হিমালয় পর্বতমালা দৃশ্যমান। হিমালয়ান আবহাওয়া এই অঞ্চলকে প্রভাবিত করে সবসময়। খামারটি প্রায় ৪৫০০ বর্গমিটার জুড়ে অবস্থিত। পাহাড়ের গায়ে উচুঁ নীচু বৈশিষ্ট্য, বন, বন্য প্রাণী, পাখি এবং মানুষের বসতির সংমিশ্রণে হাসেরা কৃষি খামারটি গড়ে উঠেছে। হাসেরা পারমাকালচার সেন্টারটি ফসল, প্রকৃতি প্রাণবৈচিত্র্যের একটি আন্তঃনির্ভরশীলতার ব্যতিক্রম সংহতি খুঁজে পাওয়া যায়।
পারমাকালচার বা টেকসই কৃষি ব্যবস্থা কি? তা জানার জন্য আমাদের খুব বেশিদুর যেতে হবেনা। পারমা ইংরেজি শব্দ পারমানেন্ট থেকে এসেছে যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় স্থায়িত্ব বা টেকসই। আর কালচার ইংরেজি শব্দ। যার বাংলা অর্থ সংস্কৃতি। আমরা যেমন ইংরেজিতে এগ্রিকালচার শব্দটির সাথে পরিচিত। তেমনি পারমাকালচার একটি বিষয়। আসলে কৃষি একটি সংস্কৃতি, যা হাজার হাজার বছর হতে মাটি, পানি, বায়ু এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করেই মানুষ সাংস্কৃতিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এনেছে। তাই কৃষি একটি পরিবর্তনশীল সাংস্কৃতির অন্যতম পাঠ। বিবর্তন ধারায় এর পরিবর্তন হয়েছে যুগে যুগে এবং তা হতেই থাকবে।
মিশ্র ফসলে জৈবনিরাপত্তার বেষ্টনীতে উদ্ভিদ ও ফসলের সুরক্ষা
পারমাকালচারে বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ বা ফসলের গাছে বৈচিত্র্যময় পোকার টান থাকে। একেকটি পোকার বা প্রাণের টান থাকে একেক ধরনের জাত বা উদ্ভিদের প্রতি। প্রত্যেকটি গাছ আলাদা আলাদা যেমন পোকার টান থাকে তেমনি আরেকটি গাছ বা ফসল সেই পোকার আসার বাধা সৃষ্টি করে। আবার একেক পোকা আরেক পোকাকে খেয়ে ফসলে পোকার আক্রমণ কমায়। যাকে বলা যায় ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থান। অন্যভাবে বলা যায় খাদ্য চক্র। পারমাকালচার খামারটি এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে একই সাথে হরেক রকমে শস্য, ফলমূল, ফুল, বনজ, ঔষধী গাছে সমাহার আছে। এই ফসল বা উদ্ভিদগুলো একে অপরের সহাযক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এখানে পাহাড়ি বনের পশুপাখিরাও স্বচ্ছন্দে ঘোরা ফেরা করতে পারে। কোন প্রাণ বা উদ্ভিদের বাঁধার সৃষ্টি হোক তা যেন না হয় সেভাই একের পর এক বৃত্ত বা সারিভাবে বাগানটি ডিজাইন করা হয়েছে। যেখানে কোন ধরনের হাইব্রিড গাছ বা শস্য ফসল নেই। সবই প্রাকৃতিক। যন্ত্রের ব্যবহার করা হয়না। রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার এখানে নিষিদ্ধ। পাহাড়ের গায়ে উঢ়ুঁ নীচু সারি সারি টিবির মতো ছোট বাগানগুলোতে, সবজির খেতগুলোতে শুধুমাত্র ঝারি দিয়ে পানি দেওয়া হয়। যা পাহাড়ের উপর থেকে ঝিরি ঝিরি বয়ে আসে এবং একটি জায়গায় পানিগুলো সংরক্ষণ করা হয়। সেগুলোই সবজি বা বাগানে চলে যায়। সবমিলিয়ে এখানে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সার্কেল বা চক্র তৈরি হয়। একে অপরের উপকারে আসে।
বৃষ্টি হলে মাটি ভেসে যায় না
পাহার থেকে ঝিরি ঝিরি পানির ফোয়ারা এসে একটি গর্তে জমা হয়। এভাবে ধাপে ধাপে পাহাড়ের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত পানি বয়ে এসে পড়ারর একটি জায়গা করা হয়েছে। যার ফলে পানি মাটিসহ এখানে এসে মাটিগুলো জমা হয়ে থাকে। আবার সেই মাটিগুলো, পলি পড়া, জৈবসারে মিশ্রিত মাটিগুলো তুলে বা কখনো পানির সাথে মিশে ফসলের বা বাগানে ব্যবহার করা হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের যেমন উচু-নিচু মাটি বৃষ্টির কারণে মাটির ক্ষয় হয়, বৃষ্টির কারণে মাটি পানির সাথে মিশে নীচের দিকে সরাসরি চলে যায়, সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে মাটির ক্ষয়রোধ করা যাবে। একই সাথে খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের বৃষ্টির পানি সুরক্ষায় একটি কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে। উচু নীচু ফসলী জমিতে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত এভাবে ছোট আকারে পানি সুরক্ষায় ছোট ছোট খনন করলে যেমন মাটির ক্ষয় রোধ হবে তেমনি পানি ধরে রেখে তা পরবর্তিতে ব্যবহার করা যাবে।
পারমাকালচার জৈবকৃষি নয় তবে এটি টেকসই কৃষি
পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতায় জানা যায়, পারমাকালচার অরগানিক কৃষি নয়, তবে এটিকে টেকসই কৃষি বলা যায়। এখানে সকল প্রাণের একটা মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, উন্নয়নের এবং সহসম্পর্কের মধ্যে দিয়ে ফসল চাষাবাদ করা হয়। কৃত্রিমভাবে কোন কিছুই এখানে তৈরি করা হয়না। বরং প্রাকৃতিক উপাদানের ঘাটতি বা এরকম কোন প্রাণবৈচিত্র্যের বসবাস বা মিথস্ক্রিয়ার সংকট বা সমস্যা দেখা গেলে তা সমাধানে উদ্যোগ নেয়া হয়। যেমন মাটিতে জৈব উপাদান বা কেঁচো তুলনামূলক কমে গেলে যাতে প্রাকৃতিক কেঁেচার বসবাস বাড়ে তেমন সব উদ্যোগ নেয়া হয়। নিদিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফসলে গোমুত্র ব্যবহার করা হয় বা গোবর সার ব্যবহার করা হয় যাতে প্রাণবৈচিত্র্যের মধ্যে সহসম্পর্ক তৈরি হয়। এখানে নতুন করে কেচোঁসার তৈরি হয়না। মাটিতেই যাতে কেচো জন্ম নিতে এবং সুবিধাজন পরিবেশ পায় সেই পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। তেমিন ফসল সুরক্ষায় হয়তো কপির সাথে গাঁধাফুল লাগানো হয়েছে। যাতে কপিতে রোগ পোকার আক্রম ঠেকানে গাধাঁ ফুলের গন্ধ কাজে লাগতে পারে। এরকম কিছু পদ্ধতি এখানে করা হয়ে থাকে।
ভবিষ্যতে সবার জন্য কৃষি
পারমাকালচার চর্চার মধ্যে দিয়ে শুধু মানুষ নয়, অন্যসকল প্রাণবৈচিত্র্য, দেখা অদেখা জীব অণুজীবকে সুরক্ষার দিকগুলোও গুরুত্ব দেয়া হয়। এখানে আদিসব বীজ এবং কৃষি সাংস্কৃতির দিকগুলো সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। স্থানীয় বীজ সুরক্ষায় জন্য নিয়মিত বীজ উৎপাদন করা, নিরাপদ সবজির উৎপাদন করা, মাটির ক্ষয়রোধ করা, একইসাথে ভাবিষ্যৎ সকল প্রাণের জন্য নিরাপদ পরিবেশ অক্ষুন্ন ও উন্নয়নে পারমাকালচার বিশেষ অবদান রাখে।
পারমাকালচার বনাম কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা
প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং কার্যক্রমে সাথে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা ও দৃশ্যমান কার্যক্রমের মাধ্যমে বলা যায়, পারমাকালচার এবং এগ্রোইকোলজি উভয়ই টেকসই কৃষি ব্যবস্থা বা পদ্ধতি। যা খাদ্য উৎপাদনের সাথে পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব কমাতে সাহায্য করে। আধুনিক কৃষির বিস্তৃত দৃশ্যপটে উক্ত দুটি পদ্ধতি বর্তমান বিশে^র আলোচিত বিষয়। পারমাকালচার এবং এগ্রোইকোলজি উভয়ই টেকসই কৃষির প্রতিশ্রুতি দেয় বা চর্চা করতে উৎসাহিত করে। এগুলো কেবল কৃষি চর্চা নয়, এই পদ্ধতিগুলো দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন ও প্রকৃতির ছন্দকে মানব স্পর্শের সাথে একত্রিত করে। আবার এগুলো নতুন কোন পদ্ধতিও নয়। হাজার বছরের কৃষি সংস্কুতির বির্তন ধারাই ঘুরে ফিরে নাম বদলের পালামাত্র। অতীতে মানুষ বসবাস করতো প্রকৃতির সাথে। প্রকৃতি বিনষ্ট হোক তা কখনোই চাইতো না। কিন্তু আধুনিকতার নামে মানুষ যখন শুধু একাই বাঁচার জন্য, ভালো থাকার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলো, কিন্তু একটি সময় পার করে দেখলো এই আধুনিকতার নামে মানুষ কখনো একাই বাঁচতে পারবে না। তার সাথে পাখি, মৌমাছিসহ পৃথিবীর সকল প্রাণ প্রকৃতি, জাতি বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতির সম্পর্ক জড়িত, শুধূ সম্পর্কই না, মানুষকে ভালো থাকতে এগুলো সুরক্ষাও জরুরী। ইতিহাস বা কৃষিরবির্তন ধারায় দেখা যায় বৌদ্ধদের ‘ মান্ডালা’ চক্রের আকারে একসময় সবজির ক্ষেত করা হতো। যা এশিয়াতেই শুরু। ‘মান্ডালা’ পদ্ধতি এমন একটি কৃষি পদ্ধতি যেখানে সূর্য, মাটি, পানি, বায়ু ও সকল প্রাণকে গুরুত্ব দিয়ে সবজির ক্ষেত প্রস্তুত করা হতো। এই মান্ডালা পদ্ধতিই পশ্চিমা সাংস্কৃতিতে পারমাকালচার হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। মান্ডালা পদ্ধতি বা পারমাকালচারে লক্ষ্য হলো কৃষিতে বিভিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘ বায়োজিও কেমিক্যাল’ বৃত্ত সৃষ্টি করা। যেগুলি নিজের মতো করে গড়ে নেয় এবং তা থেকে বাঁচতে পারে নিজেরা।
উপসংহার
কৃষির সাথে উৎপাদন এবং জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে আমরা যখন সবকিছুকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু মানুষকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকি তখনই আমরা বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হই। এই প্রকৃতির মধ্যে মানুষই শুধু একা নয়, আরো দেখা অদেখা লাখো-কোটি প্রাণ আছে। সেসকল প্রাণের বেঁচে থাকার সাথে আমাদের বেঁেচ থাকার সম্পর্ক জড়িত। তাই এমন কৃষিব্যবস্থা বা পদ্ধতির চর্চা হোক যা সকল প্রাণের সুরক্ষা দেয়, সকল জাতিগোষ্ঠী মানুষের রুচিশীল খাদ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। একইসাথে বীজসহ খাদ্য সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন থাকে। এগ্রোইকোলিজি এবং পারমাকালচার এমন পদ্ধতি যা পরিবেশ সুরক্ষা করে মানুষসহ সকল প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে।