পানি বিশুদ্ধকরণের লোকায়ত পদ্ধতি
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া কোন জীবন ও প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন অসচেতন জীবন যাপনের কারণে প্রতিনিয়ত দূষণ হচ্ছে ভূ-উপরিস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদ। ফলে শহর ও গ্রামঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলে পানি দূষণের ধরন ভিন্ন ও সমস্যা সমাধানের ধরনেও রয়েছে ভিন্নতা। স্থানীয় জনগোষ্ঠী পানের অনুপযোগী পানি নিজস্ব জ্ঞান ও সহজলভ্য প্রাকৃতিক উপকরণ বালি ও পাথর দিয়েই পানি বিশুদ্ধ করে পানযোগ্য করে তুলছেন। পানি পরিশোধনের এই প্রক্রিয়াটি গ্রামের মানুষ করে আসছেন তাদের নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগ করে।
নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় ভূ-স্তরে পাথর থাকায় সাধারণত টিউবওয়েল স্থাপন করা সম্ভব হয় না। তাই ওই এলাকার বাসিন্দারা সুপেয় পানির উৎস হিসেবে ব্যবহার করেন পাহাড়ি ঝর্ণা, নদীর বালি, পাথর খুঁড়ে গর্ত করে তৈরি করা ছোট ছোট কুয়া, ছড়ার মাঝে রিংস্লাব স্থাপনের মাধ্যমে ভিন্ন ধরনের কূপ, ছড়া বা পাহাড়ের পাদদেশে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ভূগর্ভস্থ স্বচ্ছ জলের খনি (গারো ভাষায় চিমিক), বালি গর্ত করে বাঁশ দিয়ে প্রাচীর তৈরি করা কূপ, ইন্দ্রা প্রভৃতি। পানির এইসব উৎসে কোন ধরনের আয়রন বা আর্সেনিক নেই। সীমান্তবর্তী কিছু এলাকায় টিউবওয়েল বসানো হলেও সেগুলো অগভীর। ফলে এসব পানিতে আয়রণসহ অন্যান্য দূষিত উপাদান পাওয়া যায়।
আয়রণযুক্ত পানি দিয়ে শাকসবজি ধোয়া, রান্না করা যায়, খাওয়া যায়, তবে বেশিক্ষণ সংগ্রহ করা যায় না। টিউবওয়েল থেকে সংগ্রহ করার কিছুক্ষণ পরেই পানি ঘোলাতে ও লাল রঙ ধারণ করে খাবার অনুপযোগী হয়ে ওঠে। এ পানি দিয়ে চা তৈরি করা হলেও চায়ের রঙ কালো হয়ে যায়। বেগুন, কচু, কাঁচাকলার তরকারির রঙ কালো হয়ে যায়। এছাড়া এ পানি ব্যবহারে থালাবাসন লাল হয়ে যায়, দাঁত, নখ কালো হয়ে যায়, গোসল করলেও শরীর ও চুল আঠালো হয়ে যায় বলে জানান কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের নলছাপ্রা গ্রামের কৃষাণী আরতী ঘাগ্রা। এইসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি বালি ও পাথর দিয়ে পানি বিশুদ্ধকরণ পদ্ধতি তৈরি করেছেন বলে জানান।
পানি বিশুদ্ধকরণ এই পদ্ধতি তৈরির জন্য প্রয়োজন শুধুমাত্র মাটির হাড়ি ও বালি। বালির বিভিন্ন ধরন আছে। সব বালি এই পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত নয়। এর জন্য প্রয়োজন নদী বা ছড়ার কিছুটা মোটা ধরনের বালি। কেউ কেউ আবার বালির সাথে পাথরও ব্যবহার করেন। মাটির হাড়ি সবসময় হাতের কাছে না পাওয়ার কারণে অনেকেই তার পরিবর্তে প্লাস্টিকের বালতি, টিন প্রভৃতি ব্যবহার করেন। এটি তৈরির জন্য প্রথমে পাত্রের নীচে বা পাশে ছোট আকারে গর্ত করে তার উপর নেট বা পাতলা পরিস্কার কাপড় বিছিয়ে নিতে হয়। তারপর ছোট ছোট আকারের পাথর ও পাথরের উপর পাত্রের অর্ধেক পরিমাণ অংশ পর্যন্ত বালি দিয়ে পূর্ণ করতে হয়। আবার অনেকে শুধুমাত্র বালি ব্যবহার করে থাকেন। তাতেও কোন সমস্যা নেই। তারপর আয়রনযুক্ত পানি বালির উপর ঢেলে দিলেই পাত্রের নীচের গর্ত দিয়ে সম্পূর্ণ আয়রণমুক্ত স্বচ্ছ পানি সাথে সাথেই বেড়িয়ে আসে। যা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করলেও ঘোলাতে হয় না, বরং বৃষ্টির পানির মত আরো স্বচ্ছ ও পরিস্কার হতে থাকে। তবে মাঝে মাঝে বালি পরিবর্তন করতে হয়। বালিতে আয়রনের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে পানি ঢালার সাথে সাথে পাত্রের নীচের গর্ত দিয়ে পানি বেড়িয়ে আসতে সময় নেয়। আর তখনই বালি পরিবর্তন করে দিতে হয়।
এই পদ্ধতি সর্বপ্রথম কে আবিস্কার করেছে তা সঠিক করে কেউ বলতে পারে না। তবে স্থানীয় জনগোষ্ঠী আয়রনযুক্ত পানির সমস্যা সমাধানের জন্য নিজের মত করে বালি পাথর দিয়ে পানির এই বিশুদ্ধকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছেন। এই পদ্ধতি গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে এবং ব্যবহারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে জনগোষ্ঠী বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি পান করার সুযোগ পাচ্ছে এবং পানিবাহিত বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছেন।